যুদ্ধের যাত্রা যখন শুরু : বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আহছান উল্লাহ বলেন, ১৯৭১ সালের শুরুতেই দেশের অবস্থা ক্রমান্বয়ে খারাপ হতে থাকে। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষনের পর যুব সম্প্রদায়ের মধ্যে যুদ্ধে যাওয়ার প্রবনতা তৈরি হয়। এর মধ্যে ২৫ মার্চ নারকীয় তাণ্ডবের পর ২৬ মার্চ থেকে শুরু হয়ে যায় যুদ্ধ। এপ্রিল মাসের শেষের দিকে আমার জেঠা হাজী কাজিম আলী ও জেঠাত ভাই সেনা বাহিনীর সদস্য নুরুল হক আমাকে যুদ্ধে যাওয়ার জন্য অনুপ্রানিত করেন। বিশেষ করে জেঠা কাজিম আলী বললেন, ‘এখন যৌবন যার, যুদ্ধে যাওয়ার শ্রেষ্ঠ সময় তার ’। জেঠার এই কথা আমার গোটা অস্তিত্বকেই নাড়া দিল। অবশেষে ১ মে ১৯৭১ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যুদ্ধ করার জন্য চলে যাই ভারতে।
প্রশিক্ষন যখন শুরু :
বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আহছান উল্লাহ বলেন, আমি ১ মে ১৯৭১ সালে কাঠালিয়া ইয়ুত ক্যাম্পে যোগদান করি। ঐখানে পাহাড়ের উপরে ৫/৬ হাজার ছাত্রজনতা আমরা আশ্রয় নেই। সেখানে ছোট ছোট ছনের ঘর তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু কাঁথা ,বালিশ,কম্বল কিছু ছিল না। নিত্য সঙ্গি ছিল সাপ, ব্যাঙ, বিচ্ছু, কেছু, কেড়া, মসা-মাছি বড় বড় চেলা, চেঙ্গা । দিন রাতে এদের সাথে ছিল সহঅবস্থান। খাওয়ার জন্য ছিল না পানি, লঙ্গর খানায় ছিল বহু পুরানো আতপ চাউলের খিঁচুড়ি । তার মধ্যে ছিল রসুনের কোষের মত পোকা। তাও কেউ খেতে পারত, কেউ খেতে পারত না। যারা খেত, সাথে সাথে পায়খানা করে পাহাড়ে ছড়িয়ে দিত। ছিল না ডাক্তার, কবিরাজ ও ঔষধপত্র ।
আমি এফ এফ যুদ্ধা হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহন করি।যুদ্ধে যাওয়ার পূর্বে গ্রেনেড, বেনয়ট, রাইফেল, এল.এম.জি, এস.এম.জি এক্সক্লোসিভ এন্টি পার্সসোনাল মাইন, এন্টি টেঙ্ক মাইন, ২” ইঞ্চি মোটর ৩” ইঞ্চি মোটর গেরিলা যুদ্ধের যাবতীয় প্রশিক্ষণ নেই। ২নং সেক্টরে ফেনী হতে ব্রাহ্মনবাড়ীয়া, মেলাঘর ও নির্ভপুর সাব সেক্টরের অধীনে যুদ্ধ করি। সেক্টর কমান্ডার ছিলেন মেজর খালেদ মোশারফ, মেজর হায়দার, ক্যাপটিন মাহাবুব ও থানা কমান্ডার ছিলেন আব্দুল মতিন।
যুদ্ধের অণুগল্প : –
বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আহছান উল্লাহ বলেন, আমি একদিন মাত্র ৭ জন মুক্তিযোদ্ধা সাথে নিয়ে সদর দক্ষিণ উপজেলার গলিয়ারা ইউনিয়নের রামধনপুর গ্রামে দারগা বাড়িতে পাকসেনা মারার জন্য এ্যামবুশ করি। এর মধ্যে দেখা গেল ৫ জন পাক সেনা নিয়ে রামধনপুর গ্রামের শান্তি বাহিনীর চেয়ারম্যান মোঃ ইসমাইল গ্রামে প্রবেশ করে । ইসমাইলের জন্য পাক সেনাদেরকে গুলি করে যাইতাছে না। সে হানাদার বাহিনীর সদস্যদের মসজিদের পাশে রেখে দারগা বাড়িতে এসে মুক্তি বাহিনী খোঁজ করতেছে ও মুক্তিযোদ্ধাদেরকে গালাগালি করতেছে। এমন সময় মুক্তিসেনা ফয়জুল হক তাকে ধরে ফেলে এবং গলায় গামছা দিয়ে বেঁধে ২০০-৩০০ ফুট দূরে সোনায়ছরি খালে নিয়ে যায়। এদিকে পাকসেনারা তাকে না পেয়ে ফায়ার আরম্ভ করে।
এদিকে আমরা এক দল পিছিয়ে ও আরেক দল এগিয়ে গুলি করে শান্তি বাহিনীর চেয়ারম্যানকে নিয়া সোভানগর গ্রামে যাই। আমি একা মান্দারী গ্রামে সেতুর ধারে একটি জাম গাছে উঠে দেখি সেতুর নিচে হানাদার বাহিনী এ্যামবুশ করে বসে আছে। মাত্র ১০০ ফুট দূরে আমি গুলি করতে সাহস পাইনি। আমি গাছ হতে নেমে জলা দিয়া শোভানগর গ্রামে যাই।
এদিকে সারা গ্রামে খবর ছেড়িয়েছে যে, মুক্তিবাহিনীর কমান্ডারকে পাকসেনারা ধরে নিয়া গেছে। এই সময় খবর পেয়ে মিত্রবাহিনী দূতপুকুরিয়া ঘাঁটি হতে বোমা মারা আরম্ভ করে। এই দিকে শোভানগর গ্রামবাসি আমাকে পেয়ে আনন্দে আত্বাহারা ।
অন্যদিকে শান্তি বাহিনীর চেয়ারম্যানকে দেখে জনতা তাকে বেধরক মাইরপিট আরম্ভ করে। ইন্ডিয়ান আর্মি -পুলিশসহ অনেকে শান্তি বাহিনীর চেয়ারম্যানকে দেখার জন্য চলে আসে। তাকে কেউ লাথি মারে কেউ গুতা মারে আবার কেউ না থুথু মারে। এই খবর কুমিল্লা ও ত্রিপুরা সব জায়গায় খবর হয়েছে। এবং একটি দুঃসাহসিক অভিযান হয়েছে বলে সবাই মন্তব্য করেছে। এ দুঃসময় পাকসেনাদের সামনে হতে শান্তিবাহিনীর চেয়ারম্যানকে ধরে নিয়ে আসা বাস্তবিকে একটি দুঃসাহসের কাজ ছিল। পরের দিন পাকসেনাদের ব্যাংকারে সামনের কদমতলি গ্রামে নিয়ে তাকে গুলি করে হত্যা করা হয় ।
পরিচয় :
মো. আহছান উল্লাহ। পিতা মৃত মোঃ মোক্কল হোসেন ও মাতা মৃত মোসাঃ সূর্জবান বিবি। ১৯৫০ সালের ১৪ মার্চ কুমিল্লার সদর দক্ষিণ উপজেলার ৩নং গলিয়ারা ইউনিয়নের লক্ষ্মীপুর গ্রামে জন্ম গ্রহন করেন।বর্তমানে তিনি নিরিবিলি, প্লট নং-২, ব্লক-পি, সেকশন-৪, হাউজিং এস্টেট কুমিল্লায় স্থায়ী ভাবে বসবাস করে আসছেন। তিনি কুমিল্লা জেলা ত্রান ও পুর্নবাসন কর্মকর্তা হিসেবে অবসর গ্রহন করেন। তিনি ১৯৬৮ সালে কুমিল্লা লিয়াকত টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট হতে ২ বছরের সিভিল ডিপ্লোমা সম্পন্ন করেন। পরবর্তীতে ১৯৭২ সালে কুমিল্লা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে ডিপ্লোমা ইন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পরীক্ষায় সাফল্যের সাথে উত্তীর্ণ হন। ১৯৭৪ সালের ৮ নভেম্বর মোসাম্মৎ রাশেদা আক্তারের সাথে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। তিনি দুই পুত্র ও এক কন্যা সন্তানের জনক।