৪১ বছরে জমানো ৫০ লাখ টাকা করে দিলেন দান

স্টাফ রিপোর্টার
প্রকাশ: ২ years ago

চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার ফরহাদাবাদ ইউনিয়নের বাসিন্দা মোহাম্মদ আলী। বর্তমানে পরিবার নিয়ে থাকেন নগরীর পাঁচলাইশ থানার মুরাদপুর হামজারবাগ এলাকার পৈতৃক বাড়িতে। সেখানে সঙ্গে রয়েছে দুই সন্তান ও দুই পুত্রবধূ।

সত্তরোর্ধ্ব মোহাম্মদ আলী একসময় কাজ করতেন ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধি হিসেবে। সে সময় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ এলাকায় কাজ করতে গিয়ে তিনি দেখেছেন টাকার অভাবে অসহায়-গরিব রোগীদের ছুটোছুটি ও কাঙ্ক্ষিত চিকিৎসাসেবা না পাওয়ার কষ্ট। সেই থেকেই সিদ্ধান্ত নেন তাদের জন্য কিছু করার।

এর পর থেকে নতুন স্বপ্ন নিয়ে শুরু হয় মোহাম্মদ আলীর পথচলা। কখনো নাশতা খরচ বাঁচিয়ে, আবার কখনো গাড়ি ভাড়া বাঁচিয়ে সেই টাকা জমানো শুরু করেন মাটির ব্যাংক-টিনের কৌটায়। কখনো এক টাকা, কখনো দুই টাকা, আবার কখনো একশ’ টাকা। এভাবে চলতে চলতে কাটল ৪১টি বছর। দীর্ঘ এ সময়ে মোহাম্মদ আলীর ব্যাংকে জমানো টাকার পরিমাণ দাঁড়ায় ৫০ লাখ টাকায়।

তবে আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, ১৯৮০ সালে শুরু হওয়া স্বপ্ন পূরণের গতিপথ ২০২২ সালে এসেও পাল্টাননি মোহাম্মদ আলী। নিজের জমানো সেই ৫০ লাখ টাকা ক্যানসার আক্রান্ত শিশুদের চিকিৎসায় দান করে স্থাপন করেছেন অনন্য নজির।

বেসরকারি একটি ব্যাংকে ওয়াকফ হিসাব খুলে ৫০ লাখ টাকা সেখানে জমা করেন মোহাম্মদ আলী। সপ্তাহখানেক আগে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে সেই হিসাবের কাগজপত্র চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের রোগী কল্যাণ সমিতির কাছে হস্তান্তর করেন। ওয়াকফ হিসাবের ওই টাকা ব্যাংক থেকে তুলতে পারবেন না মোহাম্মদ আলী। এমনকি তুলতে পারবে না তার স্বজন ও রোগী কল্যাণ সমিতিও। কেবল বছর শেষে মুনাফা পাবে সমিতি। সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের স্বাক্ষরে মুনাফার টাকা তোলা যাবে। এক্ষেত্রে বছরে মুনাফা হিসেবে পাঁচ লাখ টাকা অর্জন হবে। সেই টাকা ব্যয় হবে ক্যানসার আক্রান্ত শিশুদের চিকিৎসায়।

এদিকে, শ্বশুরের এমন মহতী কাজে খুশি দুই পুত্রবধূ নাসরিন আকতার ও তিরবিজ আকতার। পুত্রবধূ তিরবিজ আকতার বলেন, শ্বশুরের জমানো টাকায় ক্যানসার আক্রান্ত শিশুদের চিকিৎসা হবে, এটা অত্যন্ত খুশির খবর। এ টাকায় ক্যানসার আক্রান্ত কোনো ব্যক্তি যদি সুস্থ হয়, তাহলে শ্বশুরের কষ্ট সার্থক হবে।

দীর্ঘ ৪১ বছর স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে অবিরাম ছুটে চলা সেই মোহাম্মদ আলী বলেন, আমার নানা ক্যানসারে মারা গেছেন, আমার মা ক্যানসারে মারা গেছেন। আমার ছোট বোনের মেয়ে ক্যানসারে মারা গেছে। এ নিয়ে আমার মনে একটা কষ্ট আছে। আমি যদি ক্যানসার আক্রান্তদের জন্য কিছু করতে পারি, তাহলে আমার মনের কষ্ট দূর হবে। এজন্য মূলত টাকাটা জমিয়েছি।

তিনি বলেন, আমার এসব টাকা ১৮ বছরের নিচে ক্যানসার আক্রান্তদের চিকিৎসায় ব্যয় হবে। কেননা আমি চিকিৎসকদের কাছে শুনেছি, শিশুদের ক্যানসার নিরাময়যোগ্য। যদি তারা ঠিকমতো ওষুধ ও চিকিৎসা পায়, তাহলে সুস্থ হয়ে যায়। ক্যানসারের ওষুধ অনেক দামি। গরিব শিশুদের ক্ষেত্রে ক্যানসার চিকিৎসার ব্যয় বহন করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। তাই ১৮ বছরের নিচে ক্যানসার আক্রান্তদের ক্ষেত্রে টাকাটা ব্যয় করতে বলেছি। তারা যদি চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে মা-বাবার কাছে ফিরে তাহলে আমার কষ্ট সার্থক হবে।

মোহাম্মদ আলী বলেন, ১৯৬৬ সালে বেসরকারি ওষুধ কোম্পানি তৎকালীন ফাইজারে বিক্রয় প্রতিনিধি হিসেবে চাকরি নিয়েছিলাম। এরপর ১৯৮০ সাল থেকে কিছু টাকা জমানো শুরু করি। কখনো গাড়ি ভাড়ার খরচ বাঁচিয়ে, আবার কখনো নাশতা খরচ বাঁচিয়ে গোপনে এ টাকা জমিয়েছি। বাড়িতে একটি টিনের কৌটায় টাকা জমাই। ২০০০ সালে যখন টাকার অঙ্ক বড় হয়, তখন মা-বাবার নামে ‘কাজী অ্যান্ড হোসেন ফাউন্ডেশনে’ নামে একটি হিসাব নম্বর খুলে সেখানে টাকাটা জমা করি।

তিনি বলেন, আমার স্বপ্ন ছিল ২০২১ সালের মধ্যে ৫০ লাখ টাকা জমা করে ক্যানসার আক্রান্তদের চিকিৎসা সহায়তায় দান করবো। এরই মধ্যে আমার অনেক পরিচিত ব্যক্তিবর্গ এখান থেকে টাকা নিয়ে ব্যবসা করেছেন। ব্যবসায় লাভ হওয়ার পর তারা ব্যাংক থেকে যে পরিমাণ মুনাফায় টাকা পেতেন একই পরিমাণ মুনাফা আমাকে দিয়েছেন। কেউ কেউ খুশি হয়ে আরো বেশি দিয়েছেন। এভাবে ৪১ বছরে ৫০ লাখ টাকা জমা হলো। ২০২১ সালে টাকাটা ক্যানসার আক্রান্তদের সহায়তায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের রোগী কল্যাণ সমিতিতে জমা দিই। সপ্তাহখানেক আগে ওয়াকফ হিসাবের কাগজপত্র সমিতির কাছে হস্তান্তর করেছি। এ কাজে আমার পরিবারের সবাই খুশি। তারাও আমাকে অনুপ্রেরণা দিয়েছে।

রোগী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক অভিজিৎ সাহা বলেন, আমরা কখনো কল্পনাও করিনি এ ব্যাক্তি তার দীর্ঘদিনের সঞ্চয় করা ৫০ লাখ টাকা আমাদের ফান্ডে দান করবেন। আমরা প্রথমে ভেবেছিলাম ৫০ হাজার টাকা দান করবেন। কিন্তু কাগজপত্র হাতে পেয়ে আমরা রীতিমতো হতভাগ। তার দীর্ঘ ৪১ বছর ধরে জমানো ৫০ লাখ টাকা ক্যানসারে আক্রান্ত শিশুদের চিকিৎসায় দান করেছেন।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ শামীম আহসান বলেন, এ অনুদানের টাকা ১৮ বছরের নিচে দরিদ্র ক্যানসার আক্রান্তদের ক্ষেত্রে ব্যয় হবে। মধ্যবিত্ত একজন অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তির এ দান আমাদের অনুপ্রাণিত করবে। সমাজে এখনো ভালো মানুষ রয়েছেন। আমরা মোহাম্মদ আলীকে সাধুবাদ জানাই।