১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের প্রলয়ঙ্কারী ঘূর্ণিঝড় ও আমার সংগঠক হিসেবে বেড়ে ওঠা – শাহাজাদা এমরান

স্টাফ রিপোর্টার
প্রকাশ: ২ years ago

গত ত্রিশ বছর ধরেই ভাবছি ২৯ এপ্রিলের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের পরবর্তী পর্যায়ে অসহায় উপকূলবাসীর কল্যাণে ক্ষুদ্র পরিসরে আমারও যে কিছুটা কাজ করার সুযোগ হয়েছিল সেই অভিজ্ঞতা লিখব। কিন্তু লিখব লিখব করে আর লেখা হয়নি। এরই মধ্যে ক্যালেন্ডারের পাতা থেকে ঝরে গেছে ৩১টি বছর। আমাদের এই প্রজন্মের ছেলে মেয়েরা অনুধাবনই করতে পারবে না কী ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় বয়ে গিয়েছিল সেই দিন!

১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল বাংলাদেশে দক্ষিণপূর্ব চট্টগ্রাম বিভাগের উপকূলীয় অঞ্চলে প্রায় ২৫০কিমি/ঘণ্টা বেগে আঘাত করে। এই ঘূর্ণিঝড়ের ফলে ৬মিটার (২০ ফুট) উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস উপকূলীয় এলাকা প্লাবিত করে এবং এর ফলে প্রায় ১,৩৮,০০০ মানুষ নিহত হয়, প্রায় ১ কোটি মানুষ তাদের সর্বস্ব হারায়।
তখন সবে মাত্র ২৭ ফেব্রুয়ারির ৫ম সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে বিএনপি ক্ষমতায় আসে। আর আমি তখন নারায়ণগঞ্জ জেলার সোনারগাঁও উপজেলার বৈদ্যের বাজার ইউনিয়নের বৈদ্যের বাজার এন এ এম পাইলট হাইস্কুলের নিউ টেনের ছাত্র।

আমাদের স্কুলে তখন দৈনিক ইত্তেফাক আর বাংলাদেশ অবজারভার পত্রিকা রাখত। পত্রিকা সকালে থাকত প্রধান শিক্ষকের রুমে। বেলা ১২টার পর চলে আসত শিক্ষক রুমে। তৃতীয় শ্রেণিতে থাকার সময়ই দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকা আমি পড়ে আসছি। পত্রিকা পড়ার নেশা আমার সেই শিশুকাল থেকেই। তো টিফিন আওয়ার দিলে সবাই যখন টিফিন খাওয়া কিংবা আড্ডায় ব্যস্ত থাকত আমি তখন শিক্ষক রুমে গিয়ে আস্তে করে টেবিল থেকে পত্রিকাটি নিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পড়তাম। কিছুদিন আমার এই অভ্যাস দেখে ইংরেজির মোতালিব স্যার দপ্তরিদের বসার ছোট টুলটি দেখিয়ে বলল, তুই এখানে বসে পত্রিকা পড়বি। ২৯ এপ্রিলের ঘূর্ণিঝড়ের পর ৩০ এপ্রিল থেকে আর ইত্তেফাক পড়ার সুযোগ পেতাম না আমি। কারণ, ঘূর্ণিঝড়ের খবর পড়ার জন্য তখন স্কুলের প্রতিটি শিক্ষক থেকে শুরু করে স্কুল কমিটির সদস্যরা চলে আসত স্কুলে। এ অবস্থায় বড় ভাইকে বলে নিজেই ইত্তেফাক রাখা শুরু করলাম।

প্রতিদিন পত্রিকায় ঘূর্ণিঝড়ের নানান খবর থাকত। সব খবরই ছিল বেদনায় ভরা। ঝড়ের পানি সরে যাবার পর রাস্তা ঘাটে আনাচেকানাচে মানুষের লাশের সাড়র পড়ে থাকার ছবি ছাপা হতো। গাছের ওপরও ঝুলে ছিল অসহায় মানুষের লাশ। যারা বেঁচে ছিল তাদের ছিল না বেঁচে থাকার ন্যূনতম সম্বল। ঘর নেই বাড়ি নেই, কাপড় নেই খাবার নেই পানি নেই। লজ্জা নিবারণ করার ন্যূনতম কাপড়ও অনেকের ছিল না। এ সকল খবর পড়ে আমার কিশোর মন ভারাক্রান্ত হয়ে উঠত। মনে মনে ভাবতাম, ইশ আমার একটা জামা একটা প্যান্ট যদি তাদের দিতে পারতাম। প্রতিদিন পত্রিকায় খবর আসত, প্রয়োজনের তুলনায় ত্রাণসহ সব কিছুই অপ্রতুল। সরকার থেকেও দেশবাসীকে আহ্বান জানানো হলো যার যতটুকু সম্ভব তা নিয়ে দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়াতে।

সম্ভবত মে মাসের ৪-৫ তারিখ হবে। সোনারগাঁ উপজেলার নির্বাহী অফিসার আমাদের প্রধান শিক্ষককে বললেন, ছাত্রদের মাধ্যমে টাকাপয়সা কাপড়চোপড় সংগ্রহ করার জন্য। ইউএনও’র বার্তা পেয়ে আমাদের স্কুলের তৎকালীন প্রধান শিক্ষক পরম শ্রদ্ধেয় জনাব মোসলেহ উদ্দিন স্যার বেলা ১২টার পর ক্লাস বন্ধ করে হল রুমে (তখন আমাদের হল রুম ছিল ক্লাস সিক্সের ক্লাসটি।কারণ এটি খুব বড় ছিল)।সব শিক্ষার্থীদের যেতে বললেন। সকল শিক্ষকগণও আসলেন।

হেড স্যার এক আবেগময় বক্তব্য দিলেন। স্যারের বক্তব্য শুনে আমাদের চোখ ছল ছল করে উঠল। স্যার সকল শিক্ষার্থীদের যার যতটুকু সম্ভব সাহায্য করতে বললেন এবং নবম ও দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন ইউনিটে বিভক্ত করে এলাকা ভাগ করে দিলেন। বিভিন্ন বাড়ি বাড়ি গিয়ে নগদ টাকা, পুরাতন কাপড়চোপড় উঠানোর জন্য। আনন্দ বাজার এলাকার জন্য আমাকে টিম লিডার করে সানাউল্লাহ, কুদ্দুছ, রোকসানা, বিউটিসহ ৭/৮ জনকে দায়িত্ব দিলেন।(সরি, অন্য বন্ধুদের নাম এই মুহূর্তে মনে আসছে না) ।

দায়িত্ব পেয়েই আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জ্ঞাপন করলাম আমার মনের আশা পূরণ হচ্ছে দেখে। আমি ক্লাসে গিয়ে তাৎক্ষণিক আমার টিমকে নিয়ে বসলাম। হিসেব করে দেখলাম উলুকান্দি থেকে শুরু করে আনন্দবাজারের দামোদরদী, টেকপাড়া পর্যন্ত ১০/১২টি গ্রাম হয়। পুরো এলাকা ঘুরতে বেশ কয়েকদিন লাগবে। ত্রাণ সামগ্রী উঠানোর জন্য স্যার আমাদের ছুটি দিয়েছে মাত্র দুই দিনের জন্য। তাই অগ্রাধিকারভাবে কয়েকটি গ্রাম চিহ্নিত করে আনন্দবাজারটাকে টার্গেট করলাম। কারণ এটি উপজেলার অনেক বড় বাজার আবার আমার আব্বা ভাইও ওইখানে ব্যবসা করে।

আমি আমার টিমকে বললাম যেভাবেই হোক স্যার যে ৭টি টিম করেছে এর মধ্যে আমাদের প্রথম হতে হবে। অর্থাৎ সবচেয়ে বেশি ত্রাণ উঠাতে হবে। রোকসানা বলল, তুমি টিম লিডার হিসেবে আমাদের কি খাওয়াবা আমরা প্রথম হলে। তখন স্কুলের সামনে এক ঠোঁট কাটা এক ভদ্রলোক আইসক্রিম বিক্রি করত। দাম ছিল পঁচিশ পয়সা, পঞ্চাশ পয়সা ও এক টাকা । এক টাকা দামের আইসক্রিমের উপরিভাগে নারিকেল দেওয়া হতো। তাই এটা ছিল তৎকালীন সময়ে আমাদের জন্য লোভনীয়। আমি বললাম , ঠিক আছে, তোমাদের সবাইকে ঠোঁট কাটা দাদু থেকে নারিকেলের আইসক্রিম খাওয়াবো। সবাই খুশি হলো। সিদ্ধান্ত হলো, উলুকান্দি মাদ্রাসা এলাকা থেকে ত্রাণ উঠানো শুরু করব। এ জন্য সবাই বাড়ি থেকে চটের বস্তা নিয়ে আসবে।

যে কথা সে কাজ। বন্ধুদের নিয়ে নেমে পড়লাম গ্রামে। সবার হাতে একটা করে পাটের বস্তা। বাড়ির উঠানগুলোতে ভিক্ষুকরা যেমন জোরে ডাক দিয়ে ভিক্ষা চায় ঠিক তেমনি আমরাও উঠানে (তখন প্রত্যেক বাড়িতেই বড় বড় উঠান ছিল) গিয়ে বলতাম, আমরা পাইলট স্কুল থেকে এসেছি। চট্টগ্রামে ঘূর্ণিঝড় হয়েছে। লাখ লাখ মানুষ মারা গেছে। এখনো লাখ লাখ মানুষ না খেয়ে আছে, কাপড়ের অভাবে উলঙ্গ আছে। আপনারা যে যা পারেন দেন গো মা দেন।
আমাদের কচি মনের আর্তি সবার হৃদয় ছুঁয়ে গেছে। প্রতিটি বাড়ি থেকেই কম বেশি সবাই সাহায্য করেছে। শাড়ি,লুঙ্গি, শার্ট, প্যান্ট, ওড়না, সালোয়ার ও কামিজসহ যে যা পারছে সবাই দিয়েছে। তখন পঞ্চাশ পয়সা ও পঁচিশ পয়সাও ছিল। আমরা বলতাম আট আনা আর চার আনা । অনেক পয়সা হয়ে গেল মুহূর্তেই।

এক পর্যায়ে সানাউল্লাহ বলল, দোস্ত রোকসানা আর বিউটির ক্ষুধা লেগেছে । আমি বললাম, আমার কাছে তো এখন নিজের কোন টাকা নেই। আর ত্রাণের টাকা খাইলে যদি গুনাহ হয়? এই কথা বলার পর সবাই বলল তা তো ঠিক। এর মধ্যে সামনে একটা মসজিদ ছিল। কুদ্দুছ বলল, চল হুজুররে বলি, এখান থেকে ভেঙে কিছু টাকা খেয়ে পরদিন পরিশোধ করে দিলে পাপ হবেনি। গেলাম হুজুরের কাছে। হুজুর খুব ভালো মানুষ ছিলেন। আমাদের ঘর্মাক্ত চেহারা দেখে নিজের টাকা দিয়ে দোকান থেকে নাবিস্কোর বিস্কুট খাইয়ে বললেন, তোমরা অনেক ছোয়াবের কাজ করতেছে। তোমরা যদি না খাও তাহলে তো বেশি করে ত্রাণ উঠাতে পারবা না । ছোয়াবও কম হবে। সুতরাং তোমরা আনন্দবাজার গিয়ে হোটেলে এই টাকা দিয়ে পেট ভরে ভাত খাবে । তারপর বাজার থেকে টাকা উঠাবে। এই টাকা থেকে তোমরা খেলে কোন গুনাহ হবে না। হুজুর আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন , তোমাদের জন্য দোয়া করি বাবা। এ কথা বলে তিনি নিজেও এক টাকা সাহায্য করলেন।

পরে আমরা আনন্দ বাজার গিয়ে হোটেলে গরুর মাংস আর ঘনিয়া মাছ দিয়ে ভাত খেলাম। হোটেল মালিক আমাদের কথা শুনে দাম কম রাখলেন এবং সবাইকে এক কাপ করে মিকচার ( এক কাপের অর্ধেক দুধ আর অর্ধেক গরম পানি) খাওয়ালেন।

এভাবে দুই দিন আমরা ৫/৬টি গ্রাম ঘুরে খুব সম্ভবত ৪/৫ বস্তা কাপড়, প্রায় ২/৩ হাজার টাকা আর ৩০ কেজির মতো চালও পেয়েছিলাম। পরে স্যারের পরামর্শে চালগুলো বিক্রি করে টাকা করেছিলাম।
এই কাজটি করতে গিয়ে দেখেছি আমাদের গ্রামের মানুষগুলো বিশেষ করে মহিলাগুলো কত উদার ও আন্তরিক। অনেক মায়েরা আমাদের শরবত করে দিয়েছে, কেউবা মুড়ি দিয়েছে। আনন্দ বাজারের একেবারে সংলগ্ন একটি গ্রাম নাম টেঙ্গারচর। এই টেঙ্গারচরের এক ভদ্র মহিলা আমাদের পরম মমতায় ঘরে ডেকে নিয়ে মিষ্টি আলু সিদ্ধ করে খাইয়ে ছিলেন।

দুই দিন পর আমরা তিনটি রিকশায় করে সব মালামাল নিয়ে সরাসরি প্রধান শিক্ষকের রুমের সামনে গেলাম । স্যার তো দেখে অবাক। স্যার চেয়ার থেকে উঠে দ্রুত আমাদের সামনে এসে আমার পিঠে আদর করে বলল, এমরান তোমার টিম সবচেয়ে বেশি ত্রাণ তুলেছ এবং নেতৃত্বের দিক দিয়ে তুমি আজ প্রথম । দোয়া করি , তুমি বড় সংগঠক হও। এ কথা বলেই স্যার স্কুলের দপ্তরি ইসমাইল ভাইকে বললেন, এমরানের টিমের সবার জন্য একটা করে ইকোনো কলম নিয়ে এসো । তখন মনে হয় ইকোনো কলমের দাম ছিল দুই টাকা। সেদিন হেড স্যারের হাতে এই কলম উপহার পেয়ে মনে হয়েছিল আমরা বিশাল কিছু অর্জন করেছি। আজ ৩১ বছর পরে এসেও এই সুখময় স্মৃতি ভুলতে পারছি না।

১৯৯৪ সাল থেকে কুমিল্লা শহরে বিভিন্ন পর্যায়ের সাংগঠনিক কাজ করছি। বিতর্ককে কুমিল্লার জেলা সদর থেকে শুরু করে একেবারে ইউনিয়ন এমনকি ওয়ার্ড পর্যায়ে নিয়ে যাবার জন্য দিন রাত পরিশ্রম করেছি। কুমিল্লার ১৭ উপজেলার এমন কোনো ইউনিয়ন নেই যে ইউনিয়নের যে হাই স্কুলে আমি যাইনি বিতর্কের পতাকা নিয়ে। বর্তমানে কুমিল্লার সামাজিক, সাংস্কৃতিক এমন সংগঠন খুব কমই আছে যেখানে আল্লাহর রহমতে আমি নেই। এখনো কাজ করছি অসংখ্য জাতীয় ও স্থানীয় সংগঠনে। আল্লাহর রহমতে একজন সফল সংগঠক হিসেবে পুরস্কৃত হয়েছি বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের কাছ থেকে।

আজ আমার মনে হচ্ছে, সংগঠক হিসেবে নগর কুমিল্লায় আজ আমার যে পরিচিতি তার মূলে রয়েছে সেই ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের ঘূর্ণিঝড়ের ত্রাণ কাজের অভিজ্ঞতা।

১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের ঘূর্ণিঝড়ে যে সকল মানুষ নিহত হয়েছে সবার বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করে শেষ করছি।

লেখক : সাংবাদিক ,সংগঠক ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক লেখক । ০১৭১১-৩৮৮৩০৮