ডাণ্ডাবেড়ি যেন লাল সবুজের পতাকাকেই খামচে ধরল – শাহাজাদা এমরান

সময়ের কড়চা
শাহাজাদা এমরান
প্রকাশ: ১ বছর আগে

গত ২০ ডিসেম্বর মঙ্গলবার দেশের বিভিন্ন প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক্স মিডিয়া এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ‘মায়ের জানাযার নামাজে ছেলের হাতে হাতকড়া ও পায়ে ডাণ্ডাবেড়ি পরা’ একটি ছবি ব্যাপক ভাইরাল হয়। সমালোচনার ঝড় বয়ে যায় টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া, রূপসা থেকে পাথুরিয়া পর্যন্ত। মহান বিজয়ের মাসে চরমভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয় এমন একটি ঘটনা কোন ভাবেই মেনে নেয়া যায় না। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানিদের সাথে দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধে ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্ত আর দুই লক্ষ মা বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে যে লাল সবুজ পতাকাটি পূর্ব গগণে উদিত হয়েছিল, মনে হচ্ছে ঐ হাতকড়া ও ডা-াবেড়ি যেন লাল সবুজের প্রিয় পতাকাকেই আজ খামচে ধরেছে।

পত্রিকান্তরে প্রকাশ, গত ২০ ডিসেম্বর মঙ্গলবার মায়ের মৃত্যুর খবরে গাজীপুর জেলা কারাগার থেকে প্যারোলে মুক্তি পান কালিয়াকৈর উপজেলার বোয়ালী ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি মো. আলী আজম। হাতে হাতকড়া, পায়ে ডা-াবেড়ি লাগিয়ে তাকে পাবরিয়াচালা এলাকায় নিজ বাড়িতে মায়ের লাশ দেখতে নিয়ে যায় পুলিশ। স্থানীয়দের অনুরোধেও খোলা হয়নি তার হাতকড়া-ডা-াবেড়ি । শোকাচ্ছন্ন আলী আজম হাতকড়া- ডা-াবেড়ি নিয়েই মায়ের জানাজা পড়ান। এসময় স্থানীয় লোকজন ও বিএনপি নেতাকর্মীরা ক্ষোভ প্রকাশ করেন। জানাজার একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে সমালোচনার ঝড় উঠে।

স্থানীয়রা জানান, গত ১৮ ডিসেম্বর রোববার বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে কালিয়াকৈর উপজেলার বোয়ালী ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি মো. আলী আজমের মা সাহেরা বেগম (৬৭) বার্ধক্যজনিত কারণে মারা যান। মায়ের মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে শেষবার মাকে দেখতে ও মায়ের জানাজা নিজে পড়াতে আইনজীবীর মাধ্যমে ১৯ ডিসেম্বর সোমবার প্যারোলে মুক্তির আবেদন করলে আদালত তা মঞ্জুর করেন।

তবে সোমবার না দিয়ে আদালত তাকে ২০ ডিসেম্বর মঙ্গলবার তিন ঘণ্টার জন্য প্যারোলে মুক্তি দেন। পরে তিনি প্যারোলে মুক্তি পেয়ে হাতকড়া ও পায়ে ডান্ডাবেড়ি পরা অবস্থায় নিজ বাড়ির পাশে মায়ের জানাজা পড়ান। জানাজা চলাকালেও আলী আজমের হাতে থাকা হাতকড়া ও পায়ে ডান্ডাবেড়ি খুলে দেয়া হয়নি। এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন জানাজায় উপস্থিত লোকজন।

এ বিষয়ে গাজীপুর জেলা কারাগারের সুপার মোহাম্মদ বজলুর রশিদ বলেন, ‘আলী আজমকে নয়জন পুলিশ সদস্যসহ তার বাড়িতে পাঠানো হয়েছিল। সরকারের উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশনা অনুযায়ী এবং জেল আইন অনুযায়ী তাকে পাঠানো হয়েছিল।

জানা গেছে, কালিয়াকৈর উপজেলার চন্দ্রা ত্রিমোড় এলাকায় গত ২৯ নভেম্বর আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে হামালার অভিযোগে বিস্ফোরক আইনে করা মামলায় ২রা ডিসেম্বর গ্রেপ্তার করা হয় মো. আলী আজমকে। এ মামলায় আলী আজমসহ ১১ জনের নাম উল্লেখ করা হয়। অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয় আরও ১৫০ জনকে।
এটি একটি রাজনৈতিক মামলা তা কালিয়াকৈর উপজেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ের অফিস সহকারী ও মামলার বাদী আবদুল মান্নান শেখের বক্তব্যটি এখানে উদ্ধৃতি করলেই স্পষ্ট হয়ে যায়।

মামলাটির বাদী আবদুল মান্নান শেখ ঐ দিনই গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, ঘটনা ও মামলার বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না। তিনি বলেছিলেন, ‘কসম, আমি ঘটনাস্থলে ছিলাম না। এখানে থানার আলাউদ্দিন এসআই ছিল। ওই স্যার আমারে বারবার ফোন দিয়া অস্থির কইরা ফেলছে। আমি বলছি, স্যার, আমি দাওয়াতে আছি। আমি দাওয়াতে থাইক্যা মামলা করলাম কীভাবে? আমি ছিলামও না, দেখিও নাই। স্যারেগো আমি কইছিলাম, স্যার, আমারে আপনারা ঝামেলায় ফালাইয়েন না।’

দৈনিক মানবজমিন থেকে ঐ দিনের সংবাদের প্রায় উল্লেখযোগ্য অংশ এই জন্যই এখানে উল্লেখ করলাম যে, এটি কোন হত্যা, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, ধর্ষণ, অপহরণ কিংবা এমন কোন মামলা ছিল না এবং কালিয়াকৈর উপজেলার বোয়ালী ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি মো. আলী আজমও ঐ ধরনের মামলার দাগি কোন আসামী ছিলেন না। ¯্রফে এটি একটি রাজনৈতিক মামলা এবং আলী আজম সাহেবও রাজনৈতিক কারণেই ঐ মামলার আসামী হয়েছেন। এই একটি সহজ সত্য কথা জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন, জেল খানা প্রশাসন সবাই জানত।

আমাদের দেশের সংবিধান অনুযায়ী এই প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা হচ্ছেন জনগনের চাকর। ইংরেজিতে যাকে বলা হয় পাবলিক সারভেন্ট। জনগণের ট্যাক্সের টাকায় পড়াশুনা করে, জনগনের ট্যাক্সের টাকায় বেতন বোনাস গ্রহন করে, এসি গাড়ি, বাড়িতে চড়ে ওরা ভুলেই গিয়েছে তারা এই দেশের জনগণের চাকর বৈ অন্য কোন কিছু নয়। জনগণকে সেবা করাই তাদের কাজ। কিন্তু জনগণের সেবার নাম করে এই পাবলিক সারভেন্ট গুলো যখন সাধারণ অসহায় মানুষ গুলোর হাতে হাত কড়া ও পায়ে ডা-াবেড়ি পড়ায় এমনকি জনমদু:খি মায়ের নামাজে জানাযায়ও যখন ডান্ডাবেড়ি খুলে দেয় না তখন আকাশে পত পত করে উড়তে থাকা লাল সবুজের প্রিয় পতাকাটি ডা-াবেড়িটাকে খামচে ধরতে চায়। প্রিয় পতাকাটি ঐ সকল পাবলিক সারভেন্টদের চিৎকার করে হয়তো বলতে চায়, ‘‘আরে তোরা কি জ্ঞান পাপি হয়ে গিয়েছিস, পাক হায়েনারা যেই মানবাধিকার লংঘনের দায়ে, যেই বাক স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়ার কারণে যুদ্ধ করে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে তোরা আমাকে অর্জন করলি আজ সেই তোরা কিভাবে সেই মানবাধিকারকে চরম থেকে চরমতর ভাবে ভুলন্ঠিত করছিস! তোরা কি চেয়ার পেয়ে পাগল হয়ে গিয়েছিস! তোরা কি মানুষ নামের অমানুষ হয়ে গিয়েছিস! মায়ের জানাযা থেকে পালিয়ে যাওয়ার মত কি দাগী আসামী ছিল আলী আজম’’।

গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, এই খবর পেয়ে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী ড. হাসান মাহমুদ বলেছেন, মায়ের নামাজে জানাযার সময় ডা-াবেড়ি রাখা ঠিক হয়নি। সামান্যতম এই উপলদ্ধির জন্যও মাননীয় মন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলতে চাই, মাননীয় মন্ত্রী, আজ আপনারা ক্ষমতায় আছেন। আপনারা যদি কোন একদিন ক্ষমতার বাহিরে থাকেন তখন যেন একই ঘটনার পূনরাবৃত্তি না ঘটে, সেই জন্যই প্রয়োজন জনগণের দাবীর মুখেও মায়ের নামাজে জানাযায় যারা আলী আজমের ডা-াবেড়ি খুলে দেয়নি তাদের বিচারের আওতায় আনা। আলী আজমকে যারা কারাগার থেকে নিয়ে গিয়েছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঐ সদস্যরা, নিজ দায়িত্বে কি চরম এই মানবাধিকার লঙ্ঘনের কাজটি করেছে, না কি অন্য জনের আদেশে করেছে তার সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া দরকার। গ্রামের একটি বহুল প্রচলিত প্রবাদ আছে মাননীয় তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী, প্রবাদটি বলেই আজকের এই লেখার ইতি টানতে চাই।

প্রবাদটি হলো, ক্ষেতের আইল নাকি ক্ষেতেই ভাঙ্গে…। বিষয়টি আমাদের, আপনাদের, বিরোধী দলেরসহ গোটা মানবজাতির জন্যই প্রচুর্য্য। সুতরাং প্রবাদটি মনে রাখলে আমাদের ভুল গুলো কমে আসবে। ভবিষ্যতে চেয়ার থেকে নেমে আসলেও পিছলে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা কম থাকবে। অতএব, সাধু সাবধান।

লেখক : ব্যবস্থাপনা সম্পাদক,দৈনিক আমাদের কুমিল্লা ও সাধারণ সম্পাদক,বাংলাদেশ সাংবাদিক সমিতি,কুমিল্লা জেলা শাখা, ০১৭১১-৩৮৮৩০৮।