জানতে চাইলে অনেকটা ক্ষোভ নিয়ে হারুনুর রশিদ বলেন, ‘আমরারে গজব কইরা দিছে কুমিল্লা ইপিজেড। তারার বিষাক্ত পানি দক্ষিণ কুমিল্লা খাল-বিল শেষ কইরা ফালাইছে। ইপিজেডটা চালু হওনের পর থ্যাইক্কা আমরার কষ্টের শেষ নাই। আগে এই খালে কত মাছ ধরছি। এহন মাছের পোনাও নাই। কালা পানিডির মইধ্যে পচা গন্ধ। সব তারার কেমিক্যাল। এই পানি গাত লাগলোই চুলকানি শুরু হয়।’
পাশেই আরেকটি ঝাঁকি জাল দিয়ে মাছ ধরার চেষ্টা করছিলেন বারপাড়া গ্রামের বাসিন্দা ৫৫ বছর বয়সী দেলোয়ার হোসেন। তিনি কৃষিকাজ করেন। দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘১৫ বছর আগেও এই খাল মাছে ভরা আছিল। ইপিজেড চালুর কয়েক বছর পরেরতে খালের পানির এই অবস্থা। এহন খালে মাছ নাই। এই পানি দিয়ে চাষবাস করোন যায় না। আমরা অনেক কষ্টে আছি। আমরার সুদিন মনে হইতাসে আর ফিরত না।’
সরেজমিনে দেখা গেছে, কুমিল্লা নগরের উনাইশার এলাকায় ইপিজেডের দক্ষিণ-পশ্চিম অংশের সীমানাপ্রাচীরের নিচ দিয়ে বের হচ্ছে এসব দূষিত পানি। এরপর পাশের দিশাবন্দ ও কাজীপাড়া খাল হয়ে এসব বিষাক্ত পানি ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক সংলগ্ন কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলার মোস্তফাপুরে গিয়ে গুংগাইজুরি খালে পড়ছে। উপজেলার বিজয়পুর, বারপাড়া ইউনিয়ন এলাকা হয়ে লালমাই উপজেলার বাগমারা এলাকায় গিয়ে ডাকাতিয়া নদীতে মিশছে। এই বিশাল এলাকার প্রতিটি খাল-বিল ও নালার মধ্যে গাঢ় কালো রঙের পচা ও দুর্গন্ধযুক্ত পানি। দুর্গন্ধে খালের পাশ দিয়ে চলাচলও কষ্টকর।
মোস্তফাপুর এলাকার বাসিন্দা ওমর ফারুক বলেন, ‘আগে খালের পানি দিয়ে আমরা কৃষি আবাদ করতাম। কিন্তু প্রায় ১৫ বছর ধরে এই পানি বেশি বিষাক্ত হয়ে পড়েছে। যার কারণে আমরা এখন চাষাবাদে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল বলা চলে।’
কুমিল্লা-নোয়াখালী আঞ্চলিক মহাসড়ক সংলগ্ন বারপাড়া ইউনিয়নের ভবানীপুর গ্রামে গুংগাইজুরি খালছবি: প্রথম আলো
কুমিল্লা ইপিজেড সূত্র জানান, ১৯৯৯ সালের মার্চ মাসে ২৬৭ দশমিক ৪৬ একর জায়গা নিয়ে কুমিল্লা ইপিজেড প্রকল্প অনুমোদন হয়। ২০০০ সালের ১৫ জুলাই শুরু হয় কার্যক্রম। প্রতিষ্ঠার পর এখানে কোনো ধরনের তরল বর্জ্য পরিশোধনাগার স্থাপন করা হয়নি। স্থানীয় লোকজনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ২০১১ সালের ১৩ ডিসেম্বর ইপিজেডের দক্ষিণ প্রান্তে বর্জ্য পরিশোধনাগার স্থাপন করার কাজ শুরু হয়। ২০১৪ সালের ৩০ নভেম্বর ৩৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা ব্যয়ের ওই প্রকল্পের কাজ শেষ হয়। বর্জ্য পরিশোধনাগারটি রাসায়নিক ও জৈবিক উভয় পদ্ধতিতে প্রতিদিন কমপক্ষে ১৫ হাজার ঘনমিটার বর্জ্য পরিশোধন করতে পারে। ২৪ ঘণ্টাই এটি চালু থাকলে ইপিজেডের কারখানাগুলো কেন্দ্রীয়ভাবেই বর্জ্য পরিশোধনের সুযোগ পাওয়ার কথা।
তবে স্থানীয় লোকজনের ভাষ্য, কেন্দ্রীয়ভাবে বর্জ্য পরিশোধনের কথা বলা হলেও বাস্তবতা ভিন্ন। ইপিজেড হয়েই তরল বিষাক্ত বর্জ্য নদী-নালা, পুকুর, খাল-বিল ও জলাশয়ে যাচ্ছে।
জানতে চাইলে কুমিল্লা ইপিজেডের নির্বাহী পরিচালক আবদুল্লাহ আল মাহবুব বলেন, ‘আমরা বারবারই বলছি আমাদের ৪৭টি প্রতিষ্ঠানের প্রতিটিরই তরল বর্জ্যই পরিশোধন হচ্ছে। কেন্দ্রীয় তরল বর্জ্য পরিশোধনাগার ২৪ ঘণ্টাই চালু থাকে। আমাদের একাধিক বিশেষ টিম সার্বক্ষণিক সরাসরি এবং অনলাইনের মাধ্যমে বিষয়টি মনিটরিং করেন।’
আবদুল্লাহ আল মাহবুবের দাবি, ইপিজেডের ভেতরে সিটি করপোরেশনের দুটি নালা রয়েছে। সেগুলো দিয়ে মানব বর্জ্যসহ শহরের দূষিত পানি ইডিজেডের পরিশোধিত পানির সঙ্গে একসঙ্গে বের হচ্ছে। মূলত এ কারণে মানুষ না বুঝেই তাঁদের মিথ্যা দোষারোপ করছে। এ ছাড়া পাশের বিমানবন্দর এলাকায় ডেইরি ফার্মের বর্জ্য এসব খালে যাচ্ছে।
তবে কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ছামছুল আলম বলেন, নগরের ড্রেনের পানি ওই দিকে গেলেও খালের পানি এভাবে বিষাক্ত হতে পারে না। দুর্গন্ধযুক্ত ওই বিষাক্ত কালো পানি কুমিল্লা ইপিজেডের।
পরিবেশ অধিদপ্তরের (কুমিল্লা) উপপরিচালক মোসাব্বের হোসেন মোহাম্মদ রাজিব বলেন, ‘কুমিল্লা ইপিজেডের তরল বর্জ্যে এভাবে পানি বিষাক্ত হওয়ার সুযোগ নেই বলে আমরা মনে করি। কারণ, তাদের তরল বর্জ্য পরিশোধনাগারটি ২৪ ঘণ্টা চালু থাকে। আমরা সরাসরি এবং আইপি ক্যামেরার মাধ্যমেও বিষয়টি মনিটরিং করছি।’