কুমিল্লায় ১৪ মাস পর ক্লু লেস রুমা হত্যার রহস্য উদঘাটন করল পিবিআই

# নিজ সন্তানকে শাসন করাই কাল হয়েছিল গৃহবধূ রুমার
স্টাফ রিপোর্টার
প্রকাশ: ১০ মাস আগে

২০২১ সালের ২৩ নভেম্বর কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলার বারপাড়া এলাকার মানিককান্দি ভূঁইয়া বাড়ির কবরস্থান থেকে এক নারীর মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। মরদেহ দেখেইে পুলিশ সদস্যরা বুঝতে পারেন- ওই নারী হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। তবে প্রাথমিকভাবে পরিচয় না মেলায় স্থানীয় গ্রাম পুলিশের এক সদস্য বাদী হয়ে এ ঘটনায় অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।
ওইদিনই মরদেহ মর্গে পাঠানো হলে স্বজনরা বিভিন্ন মাধ্যমে খবর পেয়ে এসে ওই নারীকে সনাক্ত করেন। ওই নারীর নাম রুমা বেগম (৩৫)। তিনি উপজেলার ইলিয়টগঞ্জ এলাকার লক্ষ্মীপুর গ্রামের মো.দুলাল মিয়ার মেয়ে এবং একই উপজেলার ভিটি চারীপাড়া গ্রামের প্রয়াত মোস্তফা মিয়ার স্ত্রী। সিয়াম হোসেন নামে ১৩ বছর বয়সী এক ছেলে রয়েছে তাঁর।
ঘটনার পর থেকেই নিহতের বাবার পরিবারের সন্দেহ শ^শুর বাড়ির লোকেরাই তাকে খুন করে পরিচয় যেন না মেলে এজন্য অনেক দূরে নিয়ে মরদেহ ফেলে এসেছে। তবে দীর্ঘ তিন মাসের তদন্তে থানা পুলিশ হত্যার নেপথ্যের কারণ জানতে পারেনি। অবশেষে পুলিশ সদর দপ্তরের নির্দেশে ঘটনার তিন মাস পর মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব পায় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই), কুমিল্লা।
মঙ্গলবার দুপুরে নিজ কার্যালয়ে পিবিআই, কুমিল্লার পুলিশ সুপার মো.মিজানুর রহমান জানান, দীর্ঘ চেষ্টার পর তাঁরা এই হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচন করতে সফল হয়েছে। লাশ উদ্ধারের দুইদিন আগে ২১ নভেম্বর সকালে ওই নারীকে শ^শুরবাড়ির লোকজন হত্যা করে। এরপর দিনভর লাশ ঘরের মধ্যে লুকিয়ে রেখে ওইদিন রাতে মানিককান্দি ভূঁইয়া বাড়ির কবরস্থানে ঝোপের মধ্যে ফেলে আসে মরদেহ। তাঁরা চেয়েছিলো যেন ওই নারীর পরিচয় না মেলে। হত্যাকাণ্ডের দিন দুপুরে ভাসুর সাফায়েত হোসেন ওই বিধবা নারীর বাবার বাড়িতে গিয়ে খবর দেয়- তাঁকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আর পরদিন থানায় নিখোঁজ হওয়ার জিডি করান শাশুড়ি রূপসী বেগমকে দিয়ে।
মিজানুর রহমান আরো জানান, এ ঘটনায় গত বছরের ২৪ আগস্ট ভাসুর সাফায়াতকে গ্রেপ্তার করা হলেও তিনি জিজ্ঞাসাবাদে মুখ খোলেননি। তবে তার কথাবার্তা আমাদের কাছে সন্দেহজনক মনে হয়েছে। সবশেষ সোমবার (২৩ জানুয়ারি) ভোরে বিধবা নারীর শ^শুর বাড়ি ধেকে আরেক ভাসুর জীবন মিয়ার স্ত্রী জ্যোৎস্না আক্তারকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়েছে। ঘটনার পর থেকে পালিয়ে থাকা জ্যোৎস্না গত রোববার রাতে গোপনে বাড়িতে আসেন। সোমবার বিকেলে হত্যাকাণ্ডের পুরো বর্ণনা দিয়ে কুমিল্লার আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন জ্যোৎস্না। মূলত সন্তানককে শাসন করা নিয়ে একটি ঘটনার জের ধরেই ভাসুর সাফায়েত, ভার ভাগিনা আল-আমিনসহ শ^শুর বাড়ির কয়েকজন মিলে রুমাকে হত্যা করে।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই, কুমিল্লার উপ-পরিদর্শক (এসআই) সাফায়েত আহাম্মদ বলেন, প্রায় ১১ বছর আগে নিহত রুমার স্বামী মারা গেছেন। তদন্তে জানা গেছে- একমাত্র সন্তানের দিকে চেয়ে তিনি শ^শুর বাড়িতে থাকতেন। কিন্তু প্রায়ই ভাসুর সাফায়েত তাকে শারীরিক নির্যাতন করতেন। কিছু হলেই মারধর করতেন। ঘটনার দিন সাফায়েতই ছিলো মূল হত্যাকারী। সাফায়েত আর তার ভাগিনা আল-আমিন রাতে গিয়ে ওই কবরস্থানে ঝোপের মধ্যে লাশ ফেলে আসে। তারা ভেবেছিলো বাড়ি থেকে অনেক দূরে হওয়ায় পরিচয় সনাক্ত হবে না।
আদালতে দেওয়া জবানবন্দি ও প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জ্যোৎস্না আক্তার বলেছেন- ঘটনার দিন সকালে ডাল রান্না না করায় ছেলে সিয়াম তাঁর মা রুমা আক্তারের সঙ্গে রাগ করে চিৎকার-চেঁচামেচি করে। এতে বিরক্ত হয়ে মা তাঁর ছেলেকে একটি চড় দেয়। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে শাশুড়ি পুত্রবধূ রুমাকে চড় দেন; এক পর্যায়ে রুমাও উত্তেজিত হয়ে শাশুড়িকে লাথি মারেন। ঘটনার সময় সাফায়েত, তাঁর মা রূপসী বেগম, পুত্রবধূ জ্যোৎস্না, কহিনুর আক্তার, সুমি আক্তার আর সাফায়েতের ভাগিনা আল-আমিন উপস্থিত ছিলেন। এমন সময় সাফায়েত ওই নারীকে মারধর করলে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন এবং সঙ্গে সঙ্গে মারা যান। এরপর শাশুড়ি আর ওই অপর তিন পুত্রবধূ রুমার লাশ সারাদিন ঘরের মধ্যে লুকিয়ে রাখেন। আর রাতে সাফায়েত ও ভাগিনা আল-আমিন লাশ ওইখানে ফেলে আসেন। এরই মধ্যে নিজেদের বাঁচাতে সাফায়েত ভিকটিমের বাবার বাড়ি গিয়ে বলেন- তিনি কিছু না বলে কোথাও চলে গেছেন। আর পরদিন নিহতের শাশুড়িকে থানায় নিয়ে ডিজি করান সাফায়েত।
এসআই সাফায়েত আহাম্মদ বলেন, সবশেষ গ্রেপ্তার হওয়া গ্রেপ্তার জ্যোৎনাকে কারাগারে পাঠিয়েছে আদালত। আর বাকি আসামিদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে। সাফায়েত কিছুদিন জেলে থেকে এখন জামিনে আছেন। শিগগিরই আসামিদের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করা হবে।