চাঁন্দপুর বেইলি সেতু কখন পূর্নাঙ্গ সেতুতে রূপান্তর হবে?

মোঃ মঈনুদ্দিন চৌধুরী
প্রকাশ: ২ years ago

১৯৯৫ সালে কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার শংকুচাইল ডিগ্রি কলেজে  শিক্ষক হিসেবে যোগদানের মাধ্যমে  কর্মজীবন শুরু করি। কুমিল্লা শহর থেকে শংকুচাইল  পর্যন্ত  যাতায়াত মোটেও সুখকর ছিলনা। কখনও ট্রেনে আবার কখনও বা ছোট ছোট বাসে অনেক সময় নিয়ে কষ্ট করে যাতায়াত করতে হত। বাসে কুমিল্লা শহর থেকে যাওয়ার সময় গোমতি নদীর উপর  নির্মিত চান্দপুর বেইলী ব্রিজ অতিক্রম করতে হত। ঐ সময় যানবাহন বলতে ছিল শুধুমাত্র দু’একটি ছোট বাস, আর ফকির বাজার পর্যন্ত ডিজেল চালিত মুষ্টিমেয় কিছু বেবী ট্যাক্সি চলাচল করত। তখন রাস্তায়  যানজট বলতে কোন কিছুর অস্তিত্ব ছিলনা।  কালের আবর্তনে  কয়েক বছর আগে সিএনজি অটোরিক্সা এবং ব্যাটারি চালিত অটোরিক্সার আকস্মিক আবির্ভাবের কারনে বাস মালিকদের একচেটিয়া আধিপত্য হ্রাস পায় এবং প্রতিযোগীতায় টিকতে না পারার কারনে কুমিল্লা-শংকুচাইল-বাগড়া সড়কে বাস মালিকগন বাস চলাচল বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন। বর্তমান সময়ে সিএনজি অটোরিক্সার চালকগন একচেটিয়া সুবিধা পাওয়ার প্রেক্ষিতে নিজেদের ইচ্ছামত সিএনজি ভাড়া বাড়িয়েই চলেছেন। কুমিল্লা থেকে শংকুচাইল পর্যন্ত  স্বাভাবিক ভাড়া হচ্ছে চল্লিশ টাকা কিন্তু সিএনজি চালকদের কেউ কেউ যাত্রীদের কাছ থেকে পঞ্চাশ টাকা নিয়ে থাকেন। প্রায়ই ভাড়া নিয়ে তাদের সাথে যাত্রী সাধারনের বাগবিতন্ডা নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা /ব্যাপার হয়ে দাড়িয়েছে। তাদের কর্মকান্ড দেখে মনে হচ্ছে যে, সরকারিভাবে তাদের কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রন করার মত কেউ নেই। অর্থাৎ তারা নিজেরাই নিজেদের নীতিনির্ধারক। যাই হোক, সময়ের আবর্তনে উক্ত সড়কে যানবাহনের সংখ্যা অত্যধিক মাত্রায় বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রায়ই সড়কটিতে মহাযানজট  নিত্য দিনের ব্যাপার হয়ে দাড়িয়েছে। সবচেয়ে অধিক যানজট দৃষ্টিগোচর হয় চান্দপুর বেইলী ব্রিজে। বর্তমান সময়ে যানবাহন প্রচুর পরিমানে থাকলেও যানজট ক্রমশ অভিশাপ হিসেবে দেখা দিচ্ছে। এলাকার জনসাধারন মনে করেন, অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ন পাশ্ববর্তী টিক্কার চর এলাকায়  গোমতি নদীর উপর পূর্ণাঙ্গ সেতু নির্মান হলেও বিশেষ গুরুত্বপূর্ন ও ব্যস্ত মহাসড়কের স্থান হিসেবে অভিহিত চান্দপুর বেইলী ব্রিজটি ভেঙ্গে এত বছরেও পূর্ণাঙ্গ সেতু নির্মান না হওয়াটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক। প্রতিদিন বিভিন্ন সরকারি, বেসরকারি ও স্বায়ত্বশাসিত সংস্থায় কর্মরত ব্যক্তিবর্গ উক্ত সড়ক দিয়ে যাতায়াত করার সময় প্রতিনিয়তই চান্দপুর বেইলী ব্রিজের কাছে এসে মহাযানজটে আটকে পড়েন। বিশেষ করে স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসায় কর্মরত শিক্ষক ও অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীগনকে অবর্ণনীয় দুর্দশার সম্মুখীন হতে হয়, এর ফলে বিভিন্ন পেশাজীবিদের কর্মঘন্টা নষ্ট হচ্ছে। তাছাড়া গুরুতর  রোগীদের হাসপাতালে  নেয়ার জন্য ব্যবহৃত  অ্যাম্বুল্যান্স যানজটের কবলে পড়লে সংস্লিষ্ট রোগীদের  মৃত্যু পর্যন্ত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এই বেইলী ব্রিজটি বহুবার নষ্ট হওয়ার প্রেক্ষিতে বারবার মেরামত করা হয়। কিন্তু  এরূপ  অস্থায়ী ব্যবস্থা মোটেও সুখকর নয়, কারন যে কোন মূহুর্তে এটি ভেঙ্গে ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। প্রতিদিন এ সড়ক দিয়ে ব্যবসায়ীসহ কুমিল্লার আশে পাশের বিভিন্ন পেশার ব্যক্তিবর্গ সাইকেল, মোটরবাইকসহ বিভিন্ন  যানবাহনের মাধ্যমে যাতায়াত করেন। তাই বেইলী ব্রিজ পর্যন্ত  স্বাভাবিকভাবেই তাদের যানজট মোকাবেলা করতে হয়। বেইলী ব্রিজ ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় বড় বাস, ট্রাকসহ ভারী যানবাহন উক্ত সড়কে চলাচল করতে পারেনা। কাজেই আর দেরি না করে যথাযথ কর্তৃপক্ষকে এই বেইলী ব্রিজ ভেঙ্গে অতিসত্বর পূর্ণাঙ্গ সেতু নির্মানের দিকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে মনোনিবেশ করতে হবে। এই সেতু নির্মানের সময় প্রকৌশলীদের লোককেন্দ্রীক দৃষ্টিভঙ্গি বিবেচনায় নিতে হবে। সেতু নির্মানের সময় তাদেরকে মনে রাখতে হবে যেন এটি ব্যাপক সামাজিক ও পরিবেশগত সুবিধা নিয়ে আসে। সেতু নির্মান শুধুমাত্র কাঠামো বা  ব্যবস্থা হিসেবে নয় বরং এটি মানুষের জীবিকা উন্নত করার উপায় হিসেবে গণ্য হওয়া উচিত। এই সেতু নির্মানের ফলে শিক্ষা ও কর্মসংস্থানে আরও গতিশীলতা সৃষ্টি হবে বলে আশা করা যায়। সেতুটি নির্মিত হলে উন্নত পরিবহন সংযোগগুলি বঞ্চিত এলাকার জন্য সমৃদ্ধির পথ, অর্থনৈতিক করিডোর তৈরি করবে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ভারসাম্য বজায় রাখতে সহায়তা করবে। সেতুটি নির্মান করা হলে সমস্ত পরিবহন নেটওয়ার্কগুলি  আরও টেকসই করা যাবে এবং একই সাথে তা জনস্বাস্থ্য ও সুস্থতার উন্নতিতে সহায়ক হবে। পথচারী এবং সাইকেল সেতু- যাকে কখনও কখনও ‘সক্রিয় ভ্রমন ‘ সেতু (Active travel bridges)-  হিসেবে উল্লেখ করা যায়, সেতুটি পূর্নাঙ্গভাবে নির্মিত হলে এটি সমস্ত বয়সের লোকদেরকে  হাঁটা বা সাইকেলে করে গন্তব্যে যেতে উৎসাহিত করবে। সেতু নির্মানের সময় এর উপরে, নিচে ও চারপাশের অবস্থা বিবেচনায় নেয়া উচিত, যেমন – আশেপাশের  জমি পুনরুজ্জ্বীবন, নতুন পাবলিক স্পেস করার সুযোগ, বসার জায়গা, ক্যাফে নির্মানের সুযোগ, সবুজ স্থানের  উন্নয়ন সাধনপূর্বক সেতু বা নদীর চারপাশে পর্যটন কেন্দ্র/ ইকো পার্ক গড়ে তোলা যায় কিনা তা ভেবে দেখা যেতে পারে। কেননা পর্যটন কেন্দ্র বা ইকো পার্ক স্থাপনের মাধ্যমে সরকার আর্থিকভাবে লাভবান হবে, যা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহায়ক ভুমিকা পালন করবে। শুধু তা-ই নয়, এটি স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার ক্ষেত্রে একটি মডেল হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।

যত্নশীল ডিজাইন এবং আলো ব্যবহারের মাধ্যমে, এমনকি ব্রীজের নিচের স্থানগুলি অন্ধকার জায়গাগুলির পরিবর্তে নিরাপদ, খোলা এবং আমন্ত্রনমূলক হতে পারে, এর ফলে মাদক ব্যবসা, চোরাচালান, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অসামাজিক কার্যকলাপ অনেকাংশেই  দূরীভূত হবে। দৃষ্টিনন্দন চাঁন্দপুর ব্রীজ নির্মিত হলে গোমতি নদীসহ কুমিল্লার সৌন্দর্য আরও বৃদ্ধি পাবে এবং এটি স্থানীয় নাগরিকদের গর্বের উৎস  বলে বিবেচিত হবে। অর্থাৎ সেতুটি কেবল কার্যকরী নয় বরং মার্জিত, দেখতে আনন্দদায়ক এবং স্বাগত জানানোর মত হতে হবে। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, পুরাতন গোমতি নদীর উভয় পাশেও পর্যটন কেন্দ্র স্থাপন করা যেতে পারে। এর ফলে কুমিল্লা শহর  আরো নান্দনিক ও সৌন্দর্য্যবহুল নগরীতে পরিণত হবে।  যে কোন সেতুর অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রভাব মানব জীবনে তাদের তাৎপর্য্যের কারনে অস্বীকার করা যায়না। আমাদের আধুনিক জীবন সেতুর সাথে যুক্ত। আমাদের ব্যক্তিগত ও পেশাগত জীবনকে সংযুক্ত করে সেতু। জীবিকার সাথে জীবন যোগ করতে গেলে সেতু হয়ে ওঠে সঙ্গী। মূলত মানুষের  যাতায়াত ব্যবস্থাকে গতিশীল করার জন্যেই ব্রীজের প্রয়োজন হয়। চান্দপুর বেইলী ব্রিজকে পুর্ণাঙ্গ সেতুতে রূপান্তর করা হলে কুমিল্লা-সিলেট মহাসড়ক চালু করা সম্ভব হবে এবং এর ফলে অতি অল্প সময়ের মধ্যে সিলেটের সাথে বিভিন্ন রুটের  যোগাযোগ স্থাপন সহজ হবে। সেতু হল জাতির  অবকাঠামোর স্বীকৃতি। আশা করি, গোমতি নদীর উপর পূর্ণাঙ্গ  ও স্থায়ী সেতু (চাঁন্দপুর সেতু) নির্মানে যথাযথ বা সংস্লিষ্ট বিভাগ জরুরি ও অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এগিয়ে আসবেন এবং স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মানে সচেষ্ট হবেন।

লেখকঃ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রথম এমফিল ডিগ্রি প্রাপ্ত গবেষক, কলামিষ্ট এবং সহকারী অধ্যাপক, ব্যবস্থাপনা বিভাগ, শংকুচাইল ডিগ্রি কলেজ, বুড়িচং, কুমিল্লা। ইমেইলঃ mdmoinuddinchowdhury.2012@gmail.com