ইটভাটায় মাটি ও কাঠের যথেচ্ছ ব্যবহার

অধ্যাপক ডা: মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ
স্টাফ রিপোর্টার
প্রকাশ: ১ বছর আগে

পটুয়াখালীতে প্রচলিত নিয়মকানুন উপেক্ষা করে চলছে ইটভাটা, সংশ্লিষ্ট দপ্তরের অনুমোদন ছাড়ই ইটভাটার মালিকারা কাঠ পোড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। জেলা প্রশাসন, সংশ্লিষ্ট দপ্তর ও উচ্চ আদালতের কয়লা পোড়ানোর নির্দেশ থাকলেও বেশির ভাগ ভাটায় রয়েছে কাঠের স্তুপ। কাঠ পোড়ানোর প্রস্তুতি নিয়েছে জেলার অধিকাংশ ভাটায়। যদিও জেলা প্রশাসন থেকে নির্দেশনা রয়েছে কোন ইটভাটায় কাঠ পোড়ানো যাবে না। জেলায় প্রায় ৮০টি ইটভাটা রয়েছে এর মধ্যে ২৩টি অনুমোদিত এবং ১৬টি অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। বিশ^স্তসূত্রে জানা যায় ৪৬টি ইটভাটাকে ছাড়পত্র দিয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তর। এসব ইটভাটা নির্মানের প্রথম ধাপে মানা হয় না নূন্যতম নীতিমালা, কৃষি জমি বিনষ্ট ও নিরীহদের জমি দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে ইটভাটাগুলো। যত্রতত্র বসতভিটা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আশেপাশে গড়ে তোলা হয়েছে ইটভাটা। অধিকাংশ সরকার দলীয় ও প্রভাবশালী থাকায় আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো ব্যবস্থা নিতে অসুবিধা হচ্ছে। ভুক্তবোগীরা বলছেন ২০১৩ সালে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় প্রনীত “ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন নিয়ন্ত্রণ আইন” এর সিকিভাগও মানছেন না ভাটা মালিকরা। দেখা গেছে লাউকাঠি ও লোহালিয়া নদীর তীরে গড়ে ওঠা একাধিক ইটভাটায় কোন কয়লা নাই। প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে ট্রলারে কাঠ এনে স্তুপ করেছেন ভাটাগুলোতে।
টাঙ্গাইলের ধানবাড়ীতে জেলা পরিবেশ অধিদপ্তরের সূত্রমতে ইটভাটার সংখ্যা ১৭টি। এর মধ্যে পৌর এলাকায় মালঞ্চ ব্রিকস্, হীরা ব্রিকস ও একতা ব্রিকস রয়েছে। ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন নিয়ন্ত্রন আইন ২০১৩ অনুযায়ী চিঠি পেয়ে পরবর্তীতে পৌর এলাকার টাকুরিয়ায় স্থাপনকৃত মমিন নামের ভাটাটি ভেঙ্গে ফেলেন মালিক পক্ষ। দেখা যায় ইটের মৌসুমে ইটভাটাগুলোয় ইট প্রস্তুত থেকে পুড়োনে কাজ চলছে পুরো দমে। বিভিন্ন এলাকা থেকে কৃষিজমির মাটি ও ট্রাক বোঝাই কাঠ ঠুকছে এসব ভাটায়, কয়লার দেখা মিলছে না এই সব ভাটায়। কাঁচা ইট পোড়াতে সাজিয়ে রাখা হয়েছে শত শত মন জ¦ালানী কাঠ, কাঠ পোড়ানোর প্রতিযোগীতায় নেমেছে ভাটা মালিকরা। প্রতিটি ভাটায় প্রতিদিন ৩০০ থেকে ৪০০ মন কাঠ পোড়ানো হচ্ছে। ফসলি জমির উপর ইটভাটা গড়ে ওঠায় কৃষকের ফসলের হচ্ছে সর্বনাশ। ইটভাটার ধোয়ায় পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। আশপাশের গাছগুলোর অবস্থা শোচনীয়। এসব দেখেও প্রশাসনের কোন নজর নাই। কোন কিছুই তোয়াক্কা না করে কাজ সেরে নিচ্ছে ভাটা মালিকরা, ইটভাটার শ্রমিকদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায় কয়লা দিয়ে ইট পোড়ানোর কথা থাকলেও এবার স্থানীয় প্রশাসন ও অন্যমহলদের মেনেজ করে কাঠ দিয়ে ইট পোড়ানো হচ্ছে।
ধনবাড়ীতে কাঠ পোড়ানোর অতিরিক্ত ধোঁয়ায় আশপাশের জমিতে ফসলের উৎপাদন কমে গেছে, হুমকির মুখে পড়েছে পরিবেশ। পাশের্^র এলাকা মধুপুরের গড় বনাঞ্চল হওয়ায় কয়লার পরিবর্তে কাঠ সহজলভ্য হিসেবে ইটভাটায় কাঠ জ¦ালানি হিসাবে দেদারছে পোড়ানো হচ্ছে। অভিযোগ উঠেছে সংশ্লিষ্ট মহলকে উৎকোচ দিয়েই ইট প্রস্তুত করে যাচ্ছে ভাটা মালিকরা। তবে জোড়ালো পদক্ষেপ নিতে উর্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছে দাবী সচেতন মহলের। অভিযোগ রয়েছে অধিকাংশ ইটভাটার মালিক ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মী এবং প্রভাবশালী। একারনে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ব্যবস্থা নিতে গড়িমসি খাচ্ছে। অনেক ভাটা থেকে মোটাদাগে মাসোহারা পাচ্ছে, কাঠ পোড়ানোর ব্যাপারটি প্রকাশ্যে চলছে বলে জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। শুধু তাই নয় এক শ্রেণীর দালালচক্র কৃষকদের ফাঁদে ফেলে কৃষি জমির উর্বর মাটি ভাটায় দিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। কৃষকরা এতে আরও ক্ষতির মুখে পড়েছে। চলতি মৌসুমে কোন ভাটাতেই ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালিত হয়নি।
কুমিল্লা জেলার সবকটি উপজেলায় খাস খতিয়ান ও ব্যক্তিমালিকানাধীনে জমির ফসল নষ্ট করে ভেকু মেশিন ব্যবহারে মাটি কেটে বিক্রি করছে কয়েকটি চক্র। ভয়ভীতি ও ছলচাতুরীতে সাধারনের মুখ বন্ধ করে রাখা হচ্ছে। প্রতিদিন শত শত ট্রাক ও লরিতে করে মাটি নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বিভিন্ন স্থানে। প্রশাসনের সামনে ভূমি আইনকে অমান্য করে চক্রটি হাতিয়ে নিছে অনেক টাকা। লোকাল মাটি আহরনের নামে কৃষি ফসলের জমির উপরিভাগের মাটি কেটে ইটভাটাতে বিক্রি করে কোটি কোটি টাকা অবৈধভাবে রোজগার করছে এক জাতীয় ভূমিদস্যু। একদিকে ফসলি জমির উপরিভাগের মাটি উজাড় করে নিয়ে যাচ্ছে অন্যদিকে ভারী ভারী পরিবহন গ্রামের চলাচলের রাস্তা দিয়ে পরিবহনের কার্য পরিচালনা করায় রাস্তা ভেঙ্গে জনদূর্ভোগ বাড়াচ্ছে। ধূলা বালিতে পরিবেশ বিপন্ন হচ্ছে। লালমাই এলাকার মাটি খুবই উর্বর । সেখানে নানাহ ফসল উৎপাদন করে কৃষককুল শান্তিতে আছে। কিন্তু মাটি খেকোরা ক্ষমতার অপব্যবহার করে জোড়পূর্বক ফসলি জমির মাটি কেটে নিচ্ছে। তাই অনুমতি ছাড়া মাটি কাটা বা কৃষি ভূমিতে ফসলের ক্ষতি হয় এমন কাজ করা থেকে কুচক্রিদের বিরত করতে অবিলম্বে আইন প্রয়োগ করা উচিত।
বৈধ-অবৈধভাবে গড়ে ওঠা এসব ভাটা ধ্বংস করছে পরিবেশ। বেশির ভাগ ইটভাটা নিয়মবহির্ভূতভাবে স্থাপন করা হয়েছে গ্রাম-গঞ্জ, শহর-বন্দরের অতি সন্নিকটে, কৃষিজমিতে, নদীর তীরে, পাহাড়ের পাদদেশে। ইটভাটাগুলো থেকে নির্গত হচ্ছে প্রচুর পরিমাণে কালো ধোঁয়া। এসব কালো ধোঁয়া পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞদের মতে, ইটভাটা থেকে সৃষ্ট দূষণে বয়স্ক ও শিশুরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এছাড়া কালো ধোঁয়ার কারণে মানুষের ফুসফুসের সমস্যা, শ^াসকষ্ট ও ঠান্ডাজনিত নানা রোগ দেখা দিতে পারে। ইটভাটার দূষণে পরিবেশ বিপর্যয়সহ কৃষি উৎপাদনও ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং গাছপালার স্বাভাবিক বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত করছে। কৃষিজমির মাটি দিয়ে ইট তৈরি করায় আবাদি জমি নষ্টের পাশাপাশি কমছে বনাঞ্চল। দেশের উন্নয়নের সঙ্গে যেমন নগরায়ণ বাড়ছে, তেমনি বাড়ছে ইটভাটার সংখ্যা। কিন্তু ইটের উৎপাদন সচল রাখতে এবং অধিক মুনাফা লাভের জন্য ব্যবসায়ীরা যেভাবে ইট উৎপাদন করে যাচ্ছেন, তাঁর চিত্র খুবই ভয়াবহ। সরকার ইট প্রস্তুত ও ইট ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন প্রণয়ন করলেও এর কোনো কার্যকারিতা ও বাস্তবায়ন নেই।