‘ ত্রিমুখি সংঘর্ষে মাধাইয়া বাজার রক্তে রঞ্জিত হয় ’

বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অণুগল্প – ৩১
শাহাজাদা এমরান।।
প্রকাশ: ২ মাস আগে

যুদ্ধের যাত্রা যখন শুরু :
বীরমুক্তিযোদ্ধা আয়েত আলী বলেন, মার্চের শুরুতেই দেশের অবস্থা ক্রমশ খারাপ হতে থাকে। তখন আমি ছোট খাট ব্যবসা করতাম। যুদ্ধের কারণে ব্যবসায়ও সুবিধা হচ্ছিল না। সারা দিন মন খারাপ থাকত। যুদ্ধে যাব কি যাব না এই নিয়ে মন দোটানায় ছিল। একদিন বাদ এশা আমাদের মসজিদের ইমাম আমাকে কাছে পেয়ে বললেন, আয়েত আলী, দেশের অবস্থা খুব খারাপ। পাঞ্জাবিরা আমাদের নিরিহ মানুষকে মারছে। তুমি যুবক মানুষ। যে কোন সময় তোমাকেও মেরে ফেলতে পারে। তাই মরতে যদি হয় দেশের জন্য যুদ্ধ করে মর। হুজুরের এই কথা শুনেই সিদ্ধান্ত নিলাম, অবশ্যই যুদ্ধ করব। বাঁচি আর মরি । মে মাসের শেষের দিকে এলাকার লিয়াকত আলী,সিদ্দিকুর রহমান ,ইসমাইলসহ আমরা ১৪জন যুবক রাত ৯টায় আমাদের দিঘির বাজার দিয়ে শোভারামপুর মহাসড়ক পাড় হয়ে সীমান্ত যাই। যাওয়ার আগে বাবা-মাকে বলে যাইনি। কারণ, বাবা,মা যদি নিষেধ করে এই ভয়ে। এখানে এসে এলাকার আরো কয়েকজনকে পাই। পরে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সোনামুড়া যাই।

প্রশিক্ষণ যখন শুরু :
সোনামুড়া যাওয়ার পরদিন আমাদেরকে ২নং সেক্টরের হেড কোয়ার্টার মেলাঘরে পাঠানো হয় । মেলাঘরে ২ দিন রেখে পাঠানো হয় পালাটোনা প্রশিক্ষন ভবনে। এই প্রশিক্ষণ ভবনের দায়িত্বে ছিলেন আমাদের দেবিদ্বারের এমপি ক্যাপ্টেন সুজাত আলী । এখানে আমাদের ৩০ জনকে ৩৫ দিনের একটি স্বল্প মেয়াদি প্রশিক্ষন দেওয়া হয়। প্রশিক্ষক ছিলেন ক্যাপ্টেন সিরাজুল ইসলাম ,ছাদেম আলী। আমি প্রশিক্ষন নেই থ্রি নট থ্রি লাইফেল ,এস এল আর , স্টেনগান চালানো ও মাইন বিস্ফোরনের ।
প্রশিক্ষন শেষে আবার আমাদের মেলাঘর পাঠানো হয়।এখানে মেজর হায়দার আমাদের ব্রিফ করেন।

যুদ্ধের অনুপম গল্প :

আগস্টের প্রথম দিকে আমি প্রথম সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেই। আমাদের ৪০জনকে নিয়ে একটি ইউনিট করা হয়। যার কমান্ডার ছিলেন আবদুল লতিফ । সোর্স মারফত আমরা জেনেছি মুরাদনগরের পান্তি বাজার সংলগ্ন নদীটি দিয়ে হানাদার বাহিনী নৌকা যোগে এক জায়গায় থেকে অপর জায়গায় আসা যাওয়া করে। এই খবরে আমরা পান্তি বাজারে অবস্থান নেই। আমাদের কমান্ডার আবদুল লতিফের নেতৃত্বে এখানে
আমাদের এলাকার মরিচাবাড়ির আবদুল বারেক,আবদুল মবিন,মফিজুল ইসলাম,আলী আকবর, মোশারফ হোসেনসহ আমরা ৪০ জন ছিলাম। আমরা সকাল থেকেই হানাদার বাহিনীর নৌকা আসার অপেক্ষায় ওৎ পেতে ছিলাম। বিকালের পর ঠিক সন্ধ্যার আগে দেখলাম একটি বড় নৌকায় করে পাঞ্জাবিরা আসতেছে। সম্ভবত তারা নৌকায় কিছুটা রিলাক্স মুডে ছিল। পাঞ্জাবি সৈন্য ভর্তি নৌকাটি যেই না ঘাটের কিছুটা কাছাকাছি এলো ঠিক সেই মুহুর্তে দুই দিক থেকে তাদের উপর অতর্কিত ভাবে আমরা ফায়ার করা শুরু করি। তারা কোন কিছু বুঝে উঠার আগেই আমরা বৃষ্টির মতো ফায়ার করতে থাকি। তখন আমার হাতে একটি থ্রি নট থ্রি রাইফেল ছিল। নৌকাটি ছিদ্র হয়ে ডুবে যায় এবং আমাদের এলোপাতারি আক্রমন ও পানিতে ডুবে ঘটনাস্থলেই ৭জন হানাদার বাহিনী মারা যায়।
আরেকটি যুদ্ধে সম্পর্কে জানতে চাইলে বীরমুক্তিযোদ্ধা আয়েত আলী জানান, ১৫ ডিসেম্বর আমরা চান্দিনার সোনামুড়া নামক গ্রাম থেকে মাধাইয়ার দিকে আসছি। এমন সময় আমরা সোর্স মারফত জানতে পারি যে, মাধাইয়া ব্রিজ সংলগ্ন এলাকায় হানাদার বাহিনীর বাংকার রয়েছে। কিন্তু সোর্সের খবর পেতে পেতে আমরা অলরেডি মাধাইয়া চলে আসি। এরই মধ্যে হানাদার বাহিনী ফায়ার শুরু করে। মাধাইয়া বাজার ব্রিজের বিপরীত দিক থেকে ফায়ার করতে করতে এগিয়ে আসতে থাকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর একটি দল মিত্র বাহিনী। শুরু হলো ত্রিমুখি সংঘর্ষ। হানাদার বাহিনী , আমরা মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী তিনটি বাহিনীই এলোপাতারী ফায়ার শুরু করছে। কে যে কাকে মারছে তখন আমরা বুঝতে পারছি না। মিত্র বাহিনী ও আমরা একে অপরকে হানাদার বাহিনী ভাবছি আর হানাদার বাহিনী ভাবছে উভয় দিকেই রয়েছি আমরা। দুপুর থেকে রাত দশটার পর্যন্ত একটানা ত্রিমুখি যুদ্ধে রক্তে রঞ্জিত হয় মাধাইয়া বাজার। এখানে অনেক হতাহত হয়। নিহতের বেশির ভাগ ছিল হানাদার বাহিনীর সদস্য। এক পর্যায়ে আমরা পেছনে ফিরে নিরাপদ দূরুত্বে চলে আসি। পরে মিত্র বাহিনীর তীব্র প্রতিরোধে হানাদার বাহিনী বাংকার ছেড়ে সেনানিবাসের দিকে অগ্রসর হয়। পরে একজন পাঞ্জাবি সৈনিক মাধাইয়া বাজারের একটি পাটের দোকানে পাটের ভিতর লুকিয়ে থাকে। ভোরে যখন দোকানের পাট গুলো দিন মজুররা ট্রাকে তুলছিলেন, তখন লাফ দিয়ে উঠে ঐ পাঞ্জাবি সৈন্য পালাবার ব্যর্থ চেষ্টা করেন। এরপর বাজারের লোকজন ঐ পাঞ্জাবি সৈন্যকে ধরে আমাদের খবর দেয়। পরে আমিসহ আরেকজন এসে তাকে ধরে নিয়ে যাই এবং তাকে আমরা পিটিয়ে মেরে ফেলি।

পরিচয় :
বীরমুক্তিযোদ্ধা মো. আয়েত আলী।পিতা মো. ফজর আলী ও মাতা মোসাম্মত হালেমা বেগম।১৯৫৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে দেবিদ্বার উপজেলার ভানী ইউনিয়নের খিরাই কান্দি গ্রামে তিনি জন্ম গ্রহন করেন। পিতা মাতার তিন ছেলে ও তিন মেয়ের মধ্যে তার অবস্থান পঞ্চম। ১৯৭১ সালে যুদ্ধচলাকালীন সময়ে জুন মাসে তিনি নূর জাহান বেগমের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তিনি এক মেয়ে ও পাঁচ ছেলের গর্বিত জনক। পরিবারের নানা আর্থিক অনটনের কারণে তিনি পড়াশুনা করতে পারেননি । ফলে নিজে বাবা হয়ে কষ্ট্ করে সব সন্তানদের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন এই বীর মুক্তিযোদ্ধা।