প্লাষ্টিক দূষণের সমাধানে সামিল হই সকলে

অধ্যাপক ডা: মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ
স্টাফ রিপোর্টার
প্রকাশ: ১ বছর আগে

পরিবেশ বিপর্যয় ও জলবায়ু পরিবর্তনে তার প্রভাব আজ বিশ্বব্যাপী আলোচনার বিষয়। সবুজ শস্য শ্যামল প্রান্তর ও বনের ধ্বংশ প্রকৃতিকে মরুতে রূপান্তরিত করছে। জমির উর্বরতা হারাচ্ছে কীটনাশকের জন্য সাথে পানি বিষাক্ত হচ্ছে। জীববৈচিত্র আজ সংকটের মুখে। নদী-নালা, খালবিল, সমুদ্রের মাছ ও অন্যান্য প্রাণীর জীবন আজ হুমকীর মুখে। বিগত ৭০ বছরে প্রায় ৮০ প্রজাতির প্রাণী নিশ্চিহ্ন হয়েছে বলে পরিবেশবীদদের ধারণা। লতাপাতা, অনেক বৃক্ষরাজী পৃথিবী থেকে আজ বিতাড়িত। শেষ কথা পরিবেশ বিপর্যয় প্রকৃতি, ধরণী, মানুষ ও প্রাণীকে চতুর্দিক থেকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে। বিশ্ব পরিবেশ দিবসে পরিবেশ সুরক্ষায় বিভিন্ন ব্যানার, পোষ্টার ও ফেষ্টুন, পরিবেশ বিপর্যয় সম্পর্কে আলোচনা, বিভিন্ন কুইজ ও অলিম্পিয়াড এর মাধ্যমে অনেক ভাবগাম্ভীর্যে দিবসটি পালন করা হয়। অনেকে মনে করেন এই সকল কর্মকান্ডের মাধ্যমে পরিবেশ সুরক্ষায় তাদের দায়িত্ব সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু আসলে কি তা আমরা ভুলে যাই আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য। প্লাষ্টিক পন্যের ব্যবহার আমাদের জীবন ব্যবস্থার অনুষঙ্গে পরিণত হয়েছে। টুথব্রাশ, কটনবার, থালাবাসন এমনকি পানির ট্যাংকিও প্লাষ্টিকের তৈরি। বিশ্বের প্রতি মিনিটে প্রায় পাঁচ লক্ষ প্লাষ্টিকের বোতল বিক্রি হয় বলে কথিত আছে। আমাদের জীবনযাত্রাকে এ প্লাষ্টিক যেমন সহজ করেছে, অনুরূপ এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া তেমনই হুমকির মধ্যে ফেলেছে পরিবেশ, প্রতিবেশ ও পৃথিবীর সকল প্রাণীকে।

বর্তমানে সিঙ্গেল ইউজ প্লাষ্টিক আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের এক বড় অংশ দখল করেছে। গৃহস্থালীর কাজে, স্কুল-কলেজে, অফিস-আদালতে, বিয়ের অনুষ্ঠানে রাস্তার পাশের দোকানগুলোতে, ছোট বড় সব আচার অনুষ্ঠানে খাবার-দাবাড় সরবরাহের ঝামেলা এড়ানোর জন্য সিঙ্গেল ইউজ প্লাষ্টিক ব্যবহার করা হয়। এসব প্লাষ্টিক পন্য ব্যবহারের পর আমরা তা যেখানে সেখানে ফেলে রাখি। এ ব্যবহৃত প্লাষ্টিক রিসাইকেল করা যায় না। এগুলো গিয়ে নদী-নালা, খাল-বিলে জমা হচ্ছে। এর জন্য আরো বেশি করে দূষণের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। দেশে বিদায়ী অর্থ বছরে ১০ লাখ ৬০ হাজার টন একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাষ্টিক বর্জ্য উৎপাদিত হয়েছে। যার মধ্যে ৯২১০৪ টনই বিভিন্ন মিনিপ্যাক ও পন্যসামগ্রীর কাভার বলে গবেষকরা বলছেন। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ওশানিক এন্ড অ্যাটমোস্ফেরিক এডমিনিষ্ট্রেশন তাদের এক গবেষণায় বলেছেন কফি, চা, কোমল পানীয় বা জুস সরবরাহের জন্য ব্যবহৃত প্লাষ্টিকের কাপ ৫০ বছর পর্যন্ত পরিবেশে টিকে থাকতে পারে। দোকান থেকে কেনা পন্য ও মুদিমাল বহন করার জন্য যে সব পলিব্যাগ ব্যবহার হয় সেগুলো প্রকৃতিতে মিশতে ২০ বছর সময় লাগে আর ডায়াপার এবং প্লাষ্টিক বোতল প্রায় ৪৫০ বছর টিকে থাকে। ব্যবহার্য টিউব, শ্যাম্পো কন্ডিশনারের মিনি প্যাক, টি ব্যাগ, প্লাষ্টিকে ওয়ান টাইম ইউজড চামচ, বিভিন্ন ধরনের খাবারের প্যাকেট, গ্লাস, প্লেট, কাপ স্ট্রসহ বিভিন্ন প্লাষ্টিক সামগ্রী বছরের পর বছর টিকে থাকতে পারে। এসব প্লাষ্টিক বর্জ্য সঠিকভাবে নিষ্কাশন না করে ফেলা হয় আশে পাশের ড্রেনে, রাস্তার পাশের গার্বেজে বা ভাগাড়ে বা জলাশয়ে। এর ফলে পানি, মাটি ও বায়ুর মতো পরিবেশের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ উপাদান সমূহে মারাত্মকরূপে দূষণ পরিলক্ষিত হচ্ছে।

শুধু কক্সবাজারেই এক বছরে ৬৯৮৪১ টন একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাষ্টিক বর্জ্য মিলেছে, আর কুতুপালং এলাকায় এর পরিমান ছিল ৯০৭৩ টন। প্লাষ্টিক ব্যবহার জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি। রোগ ও প্রজনন ক্ষমতা হ্রাস করে। স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাসে বিঘ্ন সৃষ্টি করে, ক্যান্সারের মত প্রাণঘাতী রোগের বিস্তার ঘটায়। তাছাড়া প্লাষ্টিক উৎপাদন প্রক্রিয়ায় প্রচুর গ্রীনহাউস গ্যাসের নিঃসরন ঘটে। প্লাষ্টিকের বক্সে খাবার অনেকক্ষণ রাখা হলে তা খাদ্যকে দুষিত করে ফেলে। অনেক প্রকার ক্যান্সার বিস্তৃতির অন্যতম প্রভাব এই প্লাষ্টিক। এছাড়া মাটির স্বাস্থ্যকে পানির অভ্যন্তরে যেভাবে প্রভাবিত করেছে, তাতে মনে করা হচ্ছে প্লাষ্টিক ও প্লাষ্টিকজাত পন্য পরিবেশের একটি ধরনকে এতো বদলে দিবে যে, সভ্যতা ধ্বংসের মোখোমুখি হতে পারে। হাওরে অনেক পর্যটক আসেন চিপস খাচ্ছেন কিন্তু প্যাকেটটা পানিতে ফেলছেন। পানি খাচ্ছেন, সেই বোতলটা পানিতে ফেলছেন। এটা পরিবেশের জন্য খারাপ। আমরা চাইব এসব বন্ধ করা হোক। এসব যারা করবে তাদের শাস্তির আওতায় নিয়ে আসা হোক। ময়লা, আবর্জনা, প্লাষ্টিক ফেলার জন্য মাঝি ও তার সহযোগীদের প্রশিক্ষণ দেয়া হোক যেন তাদের মাধ্যমে পর্যটকরা সচেতন হোন। এই যে পলিথিন খালবিল, ডোবা নালায় ও রাস্তাঘাটে পড়ে থাকে, জলাবদ্ধতা থেকে পরিবেশের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। এটি শুধু এখানেই শেষ নয়। সমুদ্রে গিয়ে পড়া এসব পলিবেগ সমুদ্রের গতিপ্রকৃতিই পাল্টে দিচ্ছে, যা প্রকারান্তরে জলবায়ু পরিবর্তনকে ত্বরান্বিত করছে।

আবাসিক, বাণিজ্যিক এলাকাগুলোর আশপাশ ও সীমানা প্রাচীর পরিস্কার রাখা দুরূহ ব্যাপার। প্রাচীর ধার ঘেষে প্রস্রাব করার প্রবনতা বন্ধ করা যায়নি, বন্ধ করা যায়নি সেখানে প্লাষ্টিক বর্জ্য ফেলে যাওয়ার প্রবনতা। শহরের অনেক জায়গায় এবং রাস্তার অনেক অংশে স্থায়ী ভাগাড় তৈরি হয়ে আছে। যেখানে প্লাষ্টিক বর্জ্য ফেলানো হয়। দুগন্ধ ও গা ঘিন ঘিন করা পরিবেশে আশপাশের ব্যবসায়ীরা ও বসবাসকারীরা ওষ্ঠাগত। যার যার অবস্থান থেকে নিবেদিত কর্মী হিসাবে এসকল পরিবেশ বিরোধী কর্মকান্ড থেকে সমাজকে উদ্ধার করতে হবে। ব্যক্তি প্রতিষ্ঠান, সরকার, গণমাধ্যমকর্মী, পলিসিমেকার, নেতাকর্মীরা গোটা ভ্রম্মান্ডের কল্যাণের কথা চিন্তা করে প্লাষ্টিক দূষণের বিরুদ্ধে একযোগে কাজ করে যেতে হবে। আমরা বাসাবাড়ী, গৃহকান্ডে ও অন্যান্য প্রয়োজনে যেসকল প্লাষ্টিক পন্য ব্যবহার করি, সেগুলোর বদলে, ষ্টিল, এলুমিনিয়াম, টিন, প্রয়োজনে মাটির পাত্র, চটের ব্যাগ ব্যবহারের উদ্যোগ নিতে পারি। এতে ব্যক্তি ও পরিবার যেমন সুরক্ষা পাবে তেমনি প্রকৃতি ও জলবায়ুর ভারসাম্য রক্ষায়ও নিজেকে শামিল করতে পারি। রিসাইকেল-রিসাইকেল-রিসাইকেল এর কোন বিকল্প নাই। প্রত্যেক নগরীতে, কয়েকটি শহর মিলে একটি এবং সুনির্দিষ্ট এলাকায় রিসাইকেল কর্মী, স্থান ও ফ্যাক্টরী নির্ধারণ করে দেশকে প্লাষ্টিক বর্জ্য মুক্ত রাখতে পারি। এ কর্মযজ্ঞে নিবেদিত কর্মী হিসাবে প্রত্যেকের সক্রিয় অংশগ্রহণ জরুরী হয়ে পড়েছে। প্লাষ্টিক ব্যবহার রোধে আইনী পদক্ষেপ নিতে হবে। প্লাষ্টিক পন্যের উপর অধিক হারে শুল্ক আরোপ করা যেতে পারে। প্লাষ্টিক দূষণের মাত্রা ক্রমাগত বৃদ্ধি পেতে থাকলে নিকট ভবিষ্যতে প্লাষ্টিক বর্জ্যে চাপা পড়বে মানবসভ্যতা। এখনই সময়-মারাত্মক প্লাষ্টিক দূষণ ঠেকানোর।
পরিবেশ উন্নয়নে স্থানীয় গণদাবিসমূহ
ক্স গাছপালা কেটে বড় বড় স্থাপনা তৈরী হচ্ছে বিধায় সমগ্র শহরেই রাস্তার পাশে ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের খোলা জায়গায় বৃক্ষরোপন করতে হবে।
ক্স শব্দকে বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠান, মাইকিং, হোটেল রেস্তোরা ও সভা সমিতিতে নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা নেয়া উচিত, বাস-ট্রাক দিনের বেলা শহর এলাকায় প্রবেশ বন্ধ এবং রাত্রেও নিয়ন্ত্রিত বেগ ও শব্দের শর্তে প্রবেশ করানো উচিত যা যানজট নিয়ন্ত্রণেও সহায়তা করবে।
ক্স চকবাজার, শাসনগাছা বা সকল বাস ষ্ট্যান্ডের সীমানার বাইরে বাস থামানো ও বাস থামিয়ে যাত্রী তোলা নিষিদ্ধ করতে হবে।
ক্স নতুন গোমতীর অববাহিকায় ময়লা আবর্জনা স্তুপিকৃত করা হচ্ছে। পুরাতন গোমতীতে পার্শ্ববর্তী সকলে সেনিটারী পাইপ ছেড়ে রেখেছেন। রাস্তা বা বাড়ীর আশেপাশে একটু নিম্নাঞ্চল পেলেই সে স্থানকে ডাষ্টবিন বানিয়ে ফেলা হচ্ছে-এ সকল মনোবৃত্তি সকল মহল পরিত্যাগ করতে হবে।
ক্স বহুতল ভবন নির্মাণে বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড, ১৯৯৩ অনুসরণ করা বাধ্যতামূলক।
ক্স অনেকগুলি জলাধারকে আবর্জনা ফেলার উত্তম স্থান নির্ধারন করে পরিত্যক্ত ঘোষণা করে ভূমি দখলের চেষ্টা চলছে। কুসিক এব্যাপারে নির্দেশকের ভূমিকা রেখে জলাধার গুলিকে ব্যবহার উপযোগী পুকুরে রূপান্তরিত করা উচিত।
ক্স ফুটপাথ দখলমুক্ত করতে হবে।
ক্স পুরাতন গোমতীকে দখলমুক্ত ও পরিবেশবান্ধব প্রকল্পে রূপান্তরিত করা হোক। পুরাতন গোমতীকে পরিচ্ছন্ন করে নৌবিহার উপযোগী বিনোদনে নগরবাসীকে আকৃষ্ট করে দুপাড়ে ওয়াকওয়ে তৈরির ব্যবস্থা করা হোক। অনেকের প্রত্যাশা এব্যাপারে হাতিরঝিলের মত একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা যেতে পারে।
ক্স সিঙ্গেল পিলারের অবৈধ বিলবোর্ড উচ্ছেদ করতে হবে।
ক্স পার্ক ও চিড়িয়াখানা বিনোদনের পরিবেশ সম্মত উপায়ে গড়ে তুলতে হবে ।
ক্স বর্জ্য অপসারনে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি সৃষ্টি হোক ।
ক্স নির্মানাধীন এলাকায় মাটি, বালি, সিমেন্ট/পাথর/ নির্মাণ সামগ্রী ঢেকে রাখা এবং রাস্তায় নির্মান সামগ্রী স্তুপিকৃত না করা।
ক্স কালো ধোঁয়া নিঃসরনকারী গাড়ী জব্দ করা।
ক্স অবৈধ ইটভাটাগুলো বন্ধ করা ।
ক্স মার্কেট/দোকানগুলোতে প্রতিদিনের বর্জ্য ব্যাগে ভরে রাখা এবং অপসারণ নিশ্চিত করতে সিটি কর্পোরেশনকে পদক্ষেপ নেয়া।
ক্স ড্রেন থেকে ময়লা আবর্জনা তুলে রাস্তার পাশে না রেখে সঙ্গে সঙ্গে ওয়াটার প্রুফ কনটেইনার যুক্ত গাড়ীতে নেয়া হোক ।
ক্স হাসপাতালের বর্জ্যকে ইনসিনিটারের মাধ্যমে পুড়িয়ে ফেলতে হবে ।
ক্স রাস্তার দুপাশেই ড্রেন থাকা দরকার (ম্যানহাইট পিভিসি পাইপে সমগ্র নগরী ইন্টারকানেক্টেড ড্রেনেজ)।
ক্স নগরীর বড় বড় রাস্তাসমূহ ত্রুটিমুক্তভাবে মেশিনে তৈরী করে ফুটপাত ও ডিভাইডার স্থাপন করা উচিত।
ক্স নগরীর অভ্যন্তরে ছোট রাস্তাসমূহ বিটুমিনের পরিবর্তে ইট-সিমেন্টের কংক্রীট দিয়ে তৈরী করলে ভাল।
ক্স সামান্য প্রনোদনার মাধ্যমে একটি প্রকল্প চালু করলে গার্বেজ হাউজ থেকে সার তৈরীর কারখানা স্থাপন করে সার উৎপাদন করতে পারে।
ক্স আলাদা কনটেইনার স্থাপন করে শুধু প্লাষ্টিক ও পলিব্যাগ সংগ্রহের ব্যবস্থা করে রিসাইকেলে ব্যবস্থা করা হোক।

সাবেক অধ্যক্ষ, কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ ও
সদস্য, কেন্দ্রিয় কাউন্সিল, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)