মৌসুমী সাংবাদিক, আপদ-বিপদ দুই ভাই ও সাংবাদিকতার পেশার মর্যাদা-শাহাজাদা এমরান

মন্তব্য প্রতিবেদন
শাহাজাদা এমরান
প্রকাশ: ৯ মাস আগে

মঙ্গলবার(১৮জুলাই) কথা হয়েছিল কুমিল্লার একজন নির্বাচনী কর্মকর্তার সাথে। তিনি দু:খ করে বললেন, ভাই, যে কোন ধরনের নির্বাচন আসলেই মৌসুমী নির্বাচনী সাংবাদিকদের জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে পড়ি। আর এই যন্ত্রণাটা আরো বাড়িয়ে দেয় কিছু সিনিয়র সাংবাদিক। মনে কিছু নিবেন না। তারা হয়তো প্রার্থী থেকে ঠিকাদারী নেয়। একেক জন ১০, ১৫ এমনাকি ২০ জনেরও তালিকা পাঠায় কার্ড দেওয়ার জন্য। নিউজের সাথে খবর নেই এই মৌসুমী সাংবাদিকরা কার্ড দিতে একটু দেরি হলেই আবার ক্ষেপে যায়। অথচ, আপনারা কাউকে পাঠালে সাথে ফোন দিয়ে অনুরোধও করেন। মৌসুমীরা অনেক গরম । তারা অনুরোধ বুঝেন না। বুঝেন ক্ষেপে যাওয়া। এবার আমার স্যার বললো, আচ্ছা, দেবিদ্বারের পৌরসভা নির্বাচনের জন্য যে এত সাংবাদিকদের কার্ড দিলা, কাল (১৮ জুলাই মঙ্গলবার) দেখবা কতটা মিডিয়ায় নিউজ এসেছে। আমি ১৭ জুলাই নির্বাচনের দিন এবং আজ ১৮ জুলাই টিভি, পত্রিকা ও অনলাইন (জাতীয় ও স্থানীয়) সব মিলিয়ে ২০ থেকে ২৫টি গণমাধ্যমের বেশি নাম বের করতে পারিনি। অথচ সাংবাদিকের কার্ড নিয়েছে প্রায় দুইশ।

নির্বাচনী এই কর্মকর্তা দুঃখ করে বললেন, শুধু মাত্র দৈনিক আমাদের কুমিল্লা পত্রিকার প্রথম পাতাতেই দেবিদ্বারের নিউজ এসেছে ছবিসহ ৬টি। অথচ হিসেব করে দেখলাম, আমাদের কুমিল্লা থেকেই সবচেয়ে কম কার্ড নেওয়া হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করা ঐ কর্মকর্তা বলেন, ভাই, সাংবাদিক নামধারী এই নির্বাচনী মৌসুমী সাংবাদিকদের আমরা চিনি। এদের কার্ড দিলে আপদ আসে , আর না দিলে বিপদ আসে। বলেনতো কোথায় যাব আমরা। আপনারা যারা সম্পাদক কিংবা সিনিয়র সাংবাদিক তারা কি নিউজ না লিখা মৌসুমী সাংবাদিকদের বিষয়ে ভুমিকা রাখতে পারেন না? কথা গুলো খুব মনোযোগ দিয়ে শুনলাম। হঠাৎ করে ঐ কর্মকর্তা বলে উঠলেন, এতক্ষণ যে কথা গুলো বললাম, সঠিক বলছি কিনা, কিছু যে বলছেন না ।
আমার অবস্থা এতক্ষণে হয়ে গেছে রিলিফ ওয়ার্ক গল্পের প্রধান চরিত্র হামিদের মত। কিইবা উত্তর দিব আমি। দেওয়াল সর্বস্ব জাতীয় পত্রিকা, নিয়মিত বের না হওয়া স্থানীয় পত্রিকা, আবার স্মার্ট ফোন হাতে নিয়েই টিভি শদ্ধ যুক্ত করে টিভি সাংবাদিকের পরিচয় দেওয়াসহ আকডুম, বাকডুম ও ঘোড়ার ডুম ডট কমের এই যুগে কি বা বলতে পারি আমি। আমিও যে হামিদের মত একজন। নির্বাচন আসলে যেভাবে মৌসুমী সাংবাদিকের দৌরাত্ম বেড়ে যায় , ওরা কখন আবার আমার গায়ে মৌসুমী তকমা লাগিয়ে দেয় সেই ভয় ও আমাকে মাঝে মাঝে পেয়ে বসে। তবে এবার মৌসুমী সাংবাদিকের পাশাপাশি রাজনীতির সাথে সরাসরি জড়িত এমন ব্যক্তিরাও সাংবাদিকের কার্ড গলায় ঝুলিয়ে আমাদের পূত:পবিত্র পেশাটাকে অপবিত্র করেছেন। ছাত্রলীগ –যুবলীগ করা ছেলেদের সাংবাদিক হিসেবে পর্যবেক্ষণের কার্ড দিয়ে নির্বাচন কমিশনও কিন্তু অপরাধ মুক্ত থাকতে পারেন না। এই গ্লানী তাদেরও বহন করতে হবে।
আর কথিত বলি আর হলুদ বলি, যাই বলি না কেন। আমার কাছে সোজা কথা হচ্ছে, একজন সাংবাদিকের একমাত্র, আবারো বলছি একমাত্র কাজ হচ্ছে তার গণমাধ্যমে সংবাদ সরবরাহ করা। এটা যে কোন পর্যায়ের মিডিয়া হোক না কেন।
শুধু নির্বাচন না। একজন সাংবাদিক তার পেশাগত পরিচয় দিয়ে যে কোন অনুষ্ঠানেই যান না কেন, তিনি যদি ঐ অনুষ্ঠানের সংবাদ না লিখেন কিংবা ব্যক্তিগত সমস্যার কারণে তিনি লিখতে না পারলেও তার অপর সহকর্মী দিয়ে তিনি যদি ঐ সংবাদটা সংগ্রহ করে নিজস্ব মিডিয়ায় না দেন , তাহলে আমার কাছে তিনি একশত ভাগ শুধু হলুদ সাংবাদিকই না ,তিনি একদম কাঁচা হলুদ কথিত সাংবাদিক। আর প্রিন্ট পত্রিকা বের না করে যারা পত্রিকার সম্পাদক কিংবা সাংবাদিক বলে পরিচয় দেন তারা সাচ্চা জ্ঞান পাপী। এই জ্ঞান পাপীরা যখন সাংবাদিকতা নিয়ে কথা বলেন তখন আমাদের লজ্জা পাওয়া ছাড়া আর কি-বা করার থাকে।

প্রায় প্রতিদিনই কুমিল্লা জেলা সদরসহ জেলার প্রায় সব গুলো উপজেলা থেকেই নানাজন ফোন দিয়ে বলেন, ভাই, অমুককে চিনেননি। অমুক মিডিয়ার সাংবাদিক। আমার প্রতিষ্ঠোনে এসেছে। এখন খরচ চায় ইত্যাদি। জেলা সদরসহ বিভিন্ন উপজেলাগুলোতে ইদানিং বেড়েছে ড্রেজার সাংবাদিক, ব্রিক ফ্লিড সাংবাদিক, সীমান্ত সাংবাদিক, ডিবি সাংবাদিক, থানা সাংবাদিক,হাসপাতাল সাংবাদিক,আবাসিক হোটেল সাংবাদিক,মাটি, বালু সাংবাদিক, পাসপোর্ট অফিসসহ বিভিন্ন অফিস সাংবাদিকসহ নানা ধরণের সাংবাদিক।
অপ সাংবাদিকতা নিয়ে কতিপয় সাংবাদিক, প্রকৃত সাংবাদিক নিজকে দাবী করে নানা সময় জ্ঞান দেওয়ার অপচেষ্টা করেন । তাদের বলছি,ডিবিসহ বিভিন্ন অফিস যদি আপনাকে টাকা দেয় মনে রাখবেন এটা তার বাবার কিংবা তার বেতনের টাকা থেকে দেয় না। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান(যদি দিয়ে থাকে) নিজেরা যে দূর্নীতি করে, লুটপাট করে সেই ভাগ থেকে আপনাদের মত জ্ঞান পাপীদের উৎকোচ দেয়। আমি গড়ে সবাইকে বলছি না। যারা নেন শুধু মাত্র তাদেরই বলছি। সুতরাং, মনে রাখবেন, অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহ্য করে তারা সবাই সমান অপরাধী।

চিৎকার করে বলতে চাই, আরে হলুদের ঘরে হলুদ সাংবাদিকরা, তোরা যদি ড্রেজারে যাস তাহলে নিউজ কর। কিন্তু নিউজের নামে উৎকোচ গ্রহণ করতে যাস কেন রে বাবা?

আমি পরিস্কার ভাষায় বলতে চাই, সকল মহলকে। মনে রাখবেন, যারা প্রকৃত সাংবাদিক, তারা আপনাদের এ সকল প্রতিষ্ঠানে সংবাদের প্রয়োজনে যেতে পারে তথ্যানুসন্ধ্যান করতে কিংবা বক্তব্য নেয়ার জন্য। প্রকৃত সাংবাদিকরা কখনো আপনাকে বলবে না, ভাই, আপনার বিরুদ্ধে নিউজ আছে। আপনি অমুক স্থানে দেখা করেন।

আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যদের অনুরোধ করব, সাংবাদিক লেখা অনেক কার কিংবা মোটর সাইকেলের দৌরাত্ম কুমিল্লায় এখন অনেক বেড়ে গেছে। সাংবাদিকের স্টিকার দেখলে দয়া করে তাদের গণমাধ্যমের পরিচয় নিশ্চিত হোন। কার্ড দেখালেই ছেড়ে দেবেন না। নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা করুন, যে মিডিয়ার আইডি কার্ড তিনি বহন করছেন আদৌ সেটা বের হয় কিনা। অনলাইন হলে দেখুন, সেই অনলাইনটি প্রতিদিন আপডেট দিচ্ছে কিনা? প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট সম্পাদককে ফোন করে নিশ্চিত হোন।

খুব কষ্ট করে বলছি, সাংবাদিকতা ছাড়া জীবনে আর কিছু শিখিনি। সাংবাদিকতাও যে গত ত্রিশ বছরেও খুব বেশি শিখে ফেলেছি তা বড় গলায় বলার মত স্পর্দা আমার এখনো হয়নি। কারণ, ১৯৯৪ সাল থেকে যে শিখতে শুরু করেছি এখনও প্রতিনিয়ত শিখছি সাংবাদিকতা। যদি অন্য কোন পেশা থাকত তাহলে জাতীর বিবেক হিসেবে পরিচিত এই মহৎ পেশাটি ছেড়ে দিতাম। কারণ, আমার মনে হয় বাংলাদেশে সাংবাদিকতাই একমাত্র পেশা, যে পেশায় ডুকতে কোন শিক্ষা লাগে না, কারো অনুমতি লাগে না, প্রশিক্ষণ লাগে না, সনদ লাগে না, জবাবদিহীতাও করতে হয় না।
অন্য দিকে, সাংবাদিকতাই একমাত্র পেশা, যেটি আবার গরিবের ভাউজ হিসেবে পরিচিত পায়। অন্য যে কোন পেশার লোকেরা বিশেষ করে রাজনীতিবিদরা যখন যে ভাবে ইচ্ছে সাংবাদিকদের নিয়ে খেলতে স্বাচ্ছন্দবোধ করে। পক্ষে গেলে বস্তুনিষ্ট সাংবাদিক আবার নুন থেকে চুন খসলেই বস্তুনিষ্টতার জ্ঞান দিতে শুরু করে । এই জ্ঞান দিতে গিয়ে তাদের হাতে অনেক সময় চড়া মূল্যও দিতে হয় অসহায় সাংবাদিকদের।
সাংবাদিকতা এমনই একটি পেশা যে, যে পেশার কোন নির্ধারক নেই। বিএমএ কার্যালয়ে কারা যাবেন তা ডাক্তাররাই ঠিক করেন, আইনজীবী সমিতিতে কারা যাবেন তা আইনজীবীরাই নির্ধারণ করেন, ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোতে কারা প্রবেশ করবেন তা ব্যবসায়ীরা সিদ্ধান্ত নেন। শিক্ষক সমিতি কিভাবে চলবে তা শিক্ষকদের বিষয় হয়ে দাঁড়ায় ।অথচ এই পেশা গুলোর একটিও কিন্তু কোন রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে স্বীকৃতি পায়নি। এমনকি জাতীর বিবেক হিসেবেও তাদের কপালে বিশেষনটি জুটেনি। কিন্তু সাংবাদিকদের দ্বিতীয় ঘর হিসেবে পরিচিত প্রেস ক্লাবে কারা যাবে বা কারা সদস্য হবে , বা কারা বাদ যাবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা নির্ধারণ করে দেন রাজনীতিবিদরা। হালে এই সিদ্ধান্ত দেওয়ার মাত্রাটা বেড়েছে চরম থেকে চরমতর পর্যায়ে।
লেখাটি শেষ করতে চাই একটি একেবারেই টাটকা উদাহরণ দিয়ে। দেশের দুই জন চিকিৎসককে গ্রেফতার করা হয়েছে। মানুষের জীবন রক্ষাকে সর্বাগ্রে অগ্রাধিকার দিয়ে সনদ নেওয়া কুমিল্লাসহ দেশের সকল পর্যায়ের চিকিৎসকরা গত দুই দিন (১৭ ও ১৮ জুলাই) ধর্মঘট ডেকেছিলেন। তারা চেম্বারে নোটিশ দিয়ে রেখেছেন সহকর্মীর মুক্তি না দিলে দুইদিন রোগী দেখবেন না। আমি কিন্তু সম্মানিত চিকিৎসকদের আন্দোলনটি যে অযৌক্তিক তা বলছি না। আমি বরং তাদের ঐক্যটাকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে বোঝানোর জন্যই উদাহরণটি সামনে আনা। যদিও রোগীদের চিকিৎসা না দিয়ে হঠাৎ করে এমন চরম আন্দোলনে যাওয়া নৈতিক ভাবে কতটুকু যৌক্তিক সেই প্রশ্ন হয়তো কেউ কেউ তুলতেই পারেন। কিন্তু, জাতির বিবেক হিসেবে পরিচিত সাংবাদিকরা প্রতিনিয়ত কত মামলা, হামলা ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন এই খবর কেউ নেয়ও না।
যাই হোক, পরিশেষে বলতে চাই, সাংবাদিকতার মহান পেশার মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখার জন্য এগিয়ে আসতে হবে সবাইকে। তবে সবার আগে এগিয়ে আসতে হবে শুধু কুমিল্লা নয়, সারা দেশের মূল ধারার সাংবাদিকদেরকেই। এখনো সময় আছে, ঐক্যবদ্ধ হওয়ার। হলুদ সাংবাদিকদের বয়কট করতে হবে। শিক্ষিত,মার্জিত ও রুচিশীল, মেধাবী তরুণদের জায়গায় করে দিতে হবে। আমাদের ক্ষনিক আবেগকে বিসর্জন দিয়ে বিবেককে অগ্রাধিকার দিতে হবে। তবেই যদি উন্নত হয় আমার রুটি রুজির একমাত্র সাংবাদিকতার পেশাটি।

লেখক : ব্যবস্থাপনা সম্পাদক, দৈনিক আমাদের কুমিল্লা ও সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ সাংবাদিক সমিতি কুমিল্লা জেলা শাখা। মোবাইল : ০১৭১১-৩৮৮৩০৮,e-mail :  : sahajadaamran@yahoo.com.