‘রাজাকারকে মেরে বিবস্ত্র অবস্থায় ১৩ জন নারীকে বদ্ধ ঘর থেকে উদ্ধার করি’–মো.আবুল হাশেম

বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অণুগল্প -১০
শাহাজাদা এমরান।।
প্রকাশ: ৩ মাস আগে

যুদ্ধের যাত্রা যখন শুরু :
এপ্রিলের একেবারে প্রথম দিকে সকালে ঘুম থেকে উঠে রামঘর বাজারে(খালার বাড়ি) যখন হাটাহাটি করছিলাম তখন লক্ষ করলাম বাজারের এক কোনে অনেক মানুষের জটলা। মানুষগুলোর মাঝখানে একজন লোক ঠিকানা লিখতে ছিলেন। এই মুহুর্তে তার নামটি মনে করতে পারছি না। উৎসুক হয়ে ভীর ঠেলে দেখি, যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে চায় তাদের নাম ঠিকানা লিখতেছেন তিনি। এই দৃশ্য দেখে আমার মনে আগুন জ্বলে উঠল। পাকিস্তান রাষ্টের ৫৬ ভাগ জনসংখ্যা হওয়া সত্ত্বেও তারা আমাদের শোষন করছে। ৫২ তে কেড়ে নিতে চেয়েছে মায়ের ভাষা বাংলা। না,এই অন্যায় মেনে নেওয়া যায় না। আমাদের দেশ থেকে পাকিস্তানীদের তাড়াতে হবে। করতে হবে দেশকে স্বাধীন। কিছুক্ষন এই কথাগুলো ভেবেই চিৎকার করে বললাম, ভাই আমার নাম লেখেন। আমি যুদ্ধে যাব। আমার একাগ্রতা দেখে তিনি নাম ঠিকানা লিখে বললেন, পরদিন সকালে যেন আমি নৌকাঘাটে প্রয়োজনীয় কাপড়চোপড় নিয়ে আসি।প্রশিক্ষণ যখন শুরু :
বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল হাশেম বলেন, পরদিন সকালে নৌকাঘাটে গিয়ে দেখি আমার সাথে আরো ১২জন আছেন। তাদের মধ্যে যাদের নাম এই মুহুর্তে মনে আছে তারা হলেন, রফিক,বাবু,হুমায়ুন এবং মিরেরশ্বরাইয়ের আবদুল আজিজ।আমরা দুপুর ১২টায় ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সাবরুমে গিয়ে পৌঁছি। এখান থেকে আমাদের পাঠানো হয় হরিনা প্রশিক্ষন শিবিরে। এই প্রশিক্ষন শিবিরটি ছিল ১নং সেক্টরের অধিনে আর ১নং সেক্টর কমান্ডার ছিলেন সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। এই হরিনা ক্যাম্পের কমান্ডার ছিলেন আমাদের কুমিল্লা শহরের বাদুরতলার এম এইচ চৌধুরীর মেয়ের জামাই মেজর এনামুল হক। যিনি তখন মেজর এনাম নামেই পরিচিত ছিলেন। এখানে আমরা ২ মাস প্রশিক্ষন নেই। আমাদের প্রশিক্ষক ছিলেন ময়মনসিংহের বিডিআরের হাবিলদার বাহাউদ্দিন। তিনি আবার আমাদের যুদ্ধকালীন সময়ের কমান্ডারও ছিলেন।

যুদ্ধের অনুপম গল্প :

প্রথম যুদ্ধে অংশগ্রহন সম্পর্কে জানতে চাইলে বীরমুক্তিযোদ্ধা মো.আবুল হাশেম বলেন, সম্ভবত জুন মাস হবে।কমান্ডার বাহাউদ্দিন ভাই রাতে আমাদের জানালেন, খবর এসেছে রামঘর ডাকঘরে হানাদার বাহিনী ১৫/১৬জন নারীকে ধর্ষন করে আটকে রেখেছে। আমরা কাল সকালে রামঘর গিয়ে তাদের উদ্ধার করে নিয়ে আসব। যে কোন পরিস্থিতির জন্যই তোমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। যেহেতু তোমাদের প্রথম অপারেশন তাই মনোবল চাঙ্গা রাখবে যাতে পরবর্তী পর্যায়ে তোমাদের উপর আস্থা রাখতে পারি।
পরদিন সকালে আমরা হরিনা থেকে সাবরুম এবং সাবরুম থেকে রামঘর এসে পৌঁছি। নৌকা থেকে নেমেই বুঝতে পারলাম, কমান্ডার এখানকার পরিবেশ পরিস্থিতি- সোর্স সব কিছু সম্পর্কে আগেই অবগত আছেন এবং তিনি খুব আস্থা নিয়েই স্থানীয়দের সাথে কথা বললেন। তিনিসহ আমাদের ৯জনকে তিন ভাগ করে অস্ত্রের পজিশন নিয়ে রামঘর ডাকঘরের তিন দিকে বিভক্ত করে সামনে এগুতো বললেন। আর স্থানীয় জনগন ছিল আমাদের পক্ষে। তবে কমান্ডার স্থানীয়দের আমাদের অপারেশনে সম্পৃক্ত করেননি। যদি না পরে পাক বাহিনী তাদের ক্ষতি করে বসে। একটু সামনে এসে দেখি, মতিন রাজাকার রুমের সামনে একটি ছোট টুলে থ্রি নট থ্রি রাইফেল নিয়ে বসে বসে জিমুচ্ছে। এই সুযোগে তাকে বসা থেকে উঠে দাঁড়ানোর আগেই আমরা তাকে অস্ত্র তাক করে আটক করতে সক্ষম হই। পরে তার কাছ থেকে চাবি নিয়ে রুমটি খুলে দেখি, ১৩জন যুবতী নারীর মধ্যে ৫জন নারী একেবারেই বিবস্ত্র আর ৮ জন অর্ধ বিবস্ত্র। রুমের বাহিরের আওয়াজে তারা বুঝতে পেরেছিল আমরা মুক্তিবাহিনী তাদের উদ্ধার করতে এসেছি। দড়জা খোলার পরই তারা দুই হাত দিয়ে লজ্জাস্থান ঢাকার বৃথা চেষ্টা করে হাউমাউ করে কান্না শুরু করে দিল। আমরা আমাদের গায়ের কাপড় দিয়ে কোন মতে তাদের রুম থেকে বের করে পার্শ্ববর্তী একটি হিন্দু বাড়িতে নিয়ে যাই। পরে ঐ হিন্দু বাড়ির মহিলারা নিজেদের কাপড় চোপড় দিয়ে তাদের সাহায্য করে। পড়ে আমরা এই ১৩জন অসহায় নারীকে সাবরুম থানায় হস্তান্তর করে মতিন রাজাকারকে ধোলাই দিয়ে হরিনা ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেই।
এই সফল অপারেশনের পর আমাদের ৭জনকে হরিনা থেকে করিমাটিলা নিয়ে যাওয়া হয়। এই ক্যাম্পে যৌথভাবে দায়িত্বে ছিলেন ভারতীয় ও বাঙ্গালী সেনাবাহিনী। এখানে ক্যাম্পের অধিক নিরাপত্তার জন্য ব্যাংকার খোলা হয়। পর দিন রেগুলার বাহিনীসহ আমাদের ৭২জন মুক্তিযোদ্ধাকে ৩ ভাগ করে ফেনী জেলার চম্পক নগর পাঠানো হয়। এটি শুভপুর-জয়চানপুর যুদ্ধ নামে পরিচিত। এটি ছিল একটি বড় যুদ্ধ। এবং এই যুদ্ধের জন্য আমরা থেকে শুরু করে আমাদের সেক্টর কমান্ডার পর্যায় পর্যন্ত পৃথক পৃথক অনেক কলা কৌশল নির্ধারণ করা হয়। আমাদের প্রথম কাজ ছিল ফেনীর চম্পকনগর ইপিআর অফিস এ্যাটাক এখান থেকে অস্ত্র নেওয়া। ইপিআর অফিস সংলগ্ন শুভপুর বাজার নামে একটি বড় বাজার রয়েছে।আমরা রাতের প্রথম ভাগেই বাজারটির নিয়ন্ত্রন নেই। পড়ে ইপিআর অফিসের চর্তুদিকে আমরা অবস্থান নেই। এরই মধ্যে হানাদার বাহিনী আমাদের অবস্থান জেনে যায়। রাত ১টার দিকে শুরু হয় প্রচন্ড গুলাগুলি।পুরো রাত গুলাগুলি চলে। পরদিন সকালে হানাদার বাহিনী পিছু হটার সময় জয়চানপুরে তারা আমাদের এ্যামবুশে পড়ে। এই যুদ্ধে হানাদার বাহিনীর ৮/১০ জন সৈন্য নিহত হয়। আর তারা পিছু হটার সময় স্থানীয় এক রাজাকারের কারণে আমাদের এক যোদ্ধা নিহত ও ২জন আহত হয়। পরে এই চম্পকনগর ক্যাম্প দখল করে প্রায় এক সপ্তাহে এই ক্যাম্পে আমরা অবস্থান নেই। এই ক্যাম্পে অবস্থান করেই আমরা ফেনীর সমরগঞ্জের ক্যাম্পে হামলা করি। আমাদের তীব্র গেরিলা হামলার কারণে সমরগঞ্জ ক্যাম্প ছেড়ে পালিয়ে ছাগলনাইয়া যায় হানাদার বাহিনী। আমরা আবার ছাগলনাইয়া গিয়ে তাদের প্রতিরোধ করলে তারা বাধ্য হয়ে ছাগলনাইয়াও ত্যাগ করে চট্রগ্রাম সেনা নিবাসের দিকে চলে যায়।

পরিচয় :
মো.আবুল হাশেম। পিতা আবদুর মজিদ এবং মাতা জবেদা খাতুন। ১৯৫১ সালে কুমিল্লার সদর দক্ষিণ উপজেলার গলিয়ারা ইউনিয়নের কনেশতলা গ্রামে তিনি জন্ম গ্রহন করেন। পিতা-মাতার চার মেয়ে ও এক ছেলের মধ্যে তিনি সবার বড়। তিনি ১৯৭০ সাল থেকে চট্রগ্রাম শহরে তেলের পাম্পে চাকুরী করে আসছিলেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ যখন হানাদার বাহিনী চট্রগ্রাম শহরেও গণহত্যা শুরু করে তখন অন্যান্যদের মতো তিনিও রাতের আধারে চট্রগ্রাম শহর ত্যাগ করেন। কারফিউর কারণে সারা দেশেই গাড়ি চলাচল বন্ধ ছিল। তাই কুমিল্লা নিজ বাড়িতে না গিয়ে তিনি চলে যান রামঘরের খালার বাড়িতে। এখানে আসতেও নানা পথঘাট ঘুরে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তিন দিন সময় লাগে। পাহারী আকাঁবাকা পথটি ছিল তার কাছে একেবারে অপরিচিত। রামঘরের স্থানীয় কয়েকজন হিন্দু পরিবারও যখন একই কারণে চট্রগ্রাম ছাড়ছিলেন রামঘরে যাওয়ার জন্য তখন রাস্তায় আবুল হাশেমের সাথে তাদের পরিচয় হয়। পরে তাদের সহযোগিতাই রামঘর পৌঁছেন তিনি।