‘ফিরে দেখা বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন ; প্রেক্ষিত কুমিল্লা’ বিষয়ক টক শো অনুষ্ঠিত হয়েছে। সোমবার (১৩ জানুয়ারী) রাত ৮ টায় কুমিল্লা আল নূর হসপিটাল, মিশন হাসপাতাল প্রা. লি. ও কুমিল্লা হরমোন সেন্টার ও জেনারেল হাসপাতালের সৌজন্যে দৈনিক আমাদের কুমিল্লা ও জনপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল কুমিল্লার জমিনের যৌথ উদ্যোগে ১৬৭ তম পর্বের এ টক শো অনুষ্ঠিত হয়। সাংবাদিক, সংগঠক ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক লেখক শাহাজাদা এমরানের সঞ্চালনায় টকশো তে অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের চারজন সম্মুখ সারির যোদ্ধা কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের সাবেক প্রধান সমন্বয়ক রায়হান উদ্দিন, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়ক মো. হাছান অন্তর, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের আন্দোলনকারী ইমরাত জাহান এনি, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের আন্দোলনকারী উর্মিলা প্রীতি।
এসময়, টকশো তে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নানা স্মৃতি ও আগামীর বাংলাদেশ কেমন চায় এই প্রজন্ম নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা উঠে এসেছে।
আলোচনার এক পর্যায়ে, রায়হান উদ্দিন বলেন, ১৬ বছর দেশে কোনো কিছুরই স্বাধীনতা ছিলো৷ এছাড়াও, গুম, খুন, রাহাজানি তো ছিলোই। এই সবকিছুর বিরুদ্ধেই কোটা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে স্বৈরাচারী সরকারের পতন হয়েছে। আর অন্তর্বর্তী সরকারের ৬ মাস হয়ে গিয়েছে। আর এই ৬ মাসে একেবারেই পরিবর্তন হয় নি এমন নয়। দেশের রিজার্ভ বেড়েছে, আমরা স্বাধীনভাবে কথা বলতে পারছি, চাকুরীর বয়স ৩২ করা হয়েছে। এগুলোইতো পরিবর্তন। যদিও ৬ মাসে পুরোপুরি সংস্কার সম্ভব নয়৷ হয়তো আরো কিছু সময় লাগবে এতে। আর পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলো অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সহযোগিতা করছে। ১৬ জুলাই যখন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাথে একাত্মতা পোষণ করে আন্দোলনে যোগ দেওয়ার ডাক দেয় আমি তখন ঢাকায় ছাত্রদের সাথে আন্দোলনে যোগ দিই৷ পরে, ১৮ জুলাই ভিক্টোরিয়া কলেজের শিক্ষার্থী হিসেবে কুমিল্লার আন্দোলনে যোগ দিই। তখন পুলিশ আমাদের উপর অতর্কিত হামলা চালায়৷ তখন পুলিশের সাথে টানা ৪/৫ ঘণ্টা যুদ্ধ করে আমাদের শাটডাউন কর্মসূচি সফল করি। আমরা আন্দোলনের সময় অনলাইনের মাধ্যমে মিটিং করে সিদ্ধান্ত নিতাম কখন কি হবে। আমাদের ৭ জনের একটি সিক্রেট গ্রুপ ছিলো। আর তখন কুমিল্লার আন্দোলন সফল করার ভার যখন আমার কাঁধে আসে তখন আমি রাজনৈতিক দলগুলোর সাহায্য নিই। জামায়াতের কথা আমি বলতে পারবো না কারণ জামায়াতের কারো সাথে আমার তখন যোগাযোগ হয় নি। তবে, কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাবেক আহবায়ক হাজী ইয়াছিন ভাই, মহানগর বিএনপির সভাপতি আবু ভাই, সদস্য সচিব টিপু ভাইসহ সবাই আমার মাধ্যমে অনেককে পাঠিয়েছে আন্দোলনে। তাদের অবদান অস্বীকার কোনো উপায় নেই। তাই বলবো, আন্দোলন সফল করার পেছনে রাজনৈতিক দলগুলোর অবদানও ছিলো। আগামীতে আমরা অন্যায়, দূর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ চাই, যেখানে মানুষের কথা বলার স্বাধীনতা থাকবে। প্রশাসন দূর্নীতি করবে না, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোরে দূর্নীতি হবে না। আমি মনে করছি, নির্বাচিত সরকার আসার পরেই ক্যাম্পাসগুলোতে ছাত্রসংসদ চালু হওয়া সম্ভব।
মো. হাসান অন্তর বলেন, ৬ মাসে পরিবর্তনের কথা বলতে গেলে বলবো, মানুষ এখন অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। মানুষ এখন প্রতিবাদ করতে জানে। আর এই কারণে, আগামীতে যে সরকার ই ক্ষমতায় আসুক তারা ২৪ এর পুনরাবৃত্তি হবে এমন কোনো কাজ করতে সাহস পাবে না। আন্দোলনের শুরু থেকেই কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে যোগ দিতে উদগ্রীব হয়ে পড়ে। পরে, ৪ তারিখে আমরা সর্বপ্রথম আন্দোলন করার সিদ্ধান্ত নিই। আমরা বৃষ্টির মধ্যেই আমাদের গেইটের সামনে আমরা দাঁড়িয়ে অবস্থান কর্মসূচি করি। সেদিন থেকেই আমাদের যাত্রা শুরু। আমরা কোটবাড়ি বিশ্বরোড ব্লক করি তখন। তখন আমি এসে মহাসড়কে শুয়ে গিয়েছিলাম। আন্দোলনের সময়ের প্রতিটা দিন ছিলো বিভিষিকাময়। আন্দোলন যদি থেমে যেতো কোনো কারণে তাহলে আমাদের আর ক্যাম্পাসে ফিরে যাওয়ার উপায় থাকতো না। আমার হয়তো অনার্সও শেষ করতে পারবো না। তাই আন্দোলনের সময় বড় ভাইয়েরা বলেছিলো – পেছনে ফেরার সুযোগ নেই। সামনে এগিয়ে যেতে হবে। ১৮ জুলাইয়ের সেই আন্দোলনের কথা মনে হলে আমি শিউড়ে উঠি। পুলিশ, বিজিবি আমাদের উপর অতর্কিত ঝাঁপিয়ে পড়ে৷ ঐসময় আমাদেরকে এলাকার মানুষেরা সহযোগীতা করেছিলো৷ তারা আমাদেরকে ইটের কণা এনে দিয়ো। আগ্নেয়াস্ত্রের বিপরীতে আমাদের একমাত্র অস্ত্র ছিলো ইটের কণা। তখন দেখেছি, নবম-দশম শ্রেণীতে পড়ুয়া শিক্ষার্থীরাও আন্দোলনে যোগ দেয়। আমাদের আগামীতে এমন বাংলাদেশ চাই, যেখানে কোনো ফ্যাসিজম থাকবে না। মানুষের কথা বলার অধিকার কেড়ে নেওয়া তেমন কোনো অশুভ শক্তি থাকবে না। আগামীর দেশ হবে সাম্য, ন্যায় এবং উন্নয়নের দেশ। আর আমি মনে করি, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্রসংসদ চালু হওয়া সময়ের দাবি।
ইমরাত জাহান এনি বলেন, ৬ মাস ১৬ বছরের তুলনায় বেশী কিছু না। ৬ মাস ঐভাবে সংস্কার সম্ভব নয়। আমাদের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি, আমরা এখন সবকিছু নিয়ে প্রশ্ন করতে জানি৷ আর আগামীতে যেকোনো বিপ্লবে আমরা রুখে দাঁড়াতে পারবো৷ এটাই আমাদের স্বার্থকতা৷ আমার এলাকা সাবেক আইনমন্ত্রীর এলাকা। তাই আমি শুরুতেই সবার ঘরে ঘরে গিয়ে সচেতন করি। আমি তখন পরিসংখ্যান শুমারীতে কাজ করতাম। রিয়া নামের একটি মেয়ে তখন বারান্দায় মারা যায়, তখন আমি আমার মেয়ের কথা ভাবি। আমার ৬ বছরের মেয়ে ছিলো তখন। আমি ৩ আগষ্ট আমার মেয়েকে নিয়ে জিলাস্কুলের সামনে আন্দোলনে যোগ দিই। আমার মেয়ে ছাত্রলীগের হাতে অস্ত্র, লাঠিসোটা দিয়ে আমাকে বলেছিলো ‘আম্মু আমরা কি আজকে মারা যাবো?’ – তখন আমি আমার মেয়েকে বুঝিয়েছিলাম আমরা আজকে মরে গেলেও অমর হয়ে যাবো। আমার ৬ বছরেএ মেয়েও তখন সবার সাথে স্লোগান দিতে লাগলো। সেদিন আমি পুলিশ লাইনে আমার সামনে গুলিবিদ্ধ হতে দেখেছি অনেককে। আমার সামনে একজন গুলিবিদ্ধ হয়। আমি তাকে নিয়ে একটি দোকানে আশ্রয় নিই। সেদিন একজন মা এসেছিলো তার দুই ছেলেকে নিয়ে। সেই মায়ের গায়েও গুলি লেগেছিলো৷ এইদিনগুলোর কথা আমি কখনো ভুলবো না। আমি একজন মা, আমি এমন একটি বাংলাদেশ চাই যেখানে আমার মেয়ে আমার কোলে নিরাপদে থাকে, যেখানে আমার বোন তার হোস্টেলে নিরাপদ থাকবে, যেখানে আমার ভাই রাজপথে যুদ্ধ করতে এসে গুলিবিদ্ধ হোক। আমি চাই, আমাদের ক্যাম্পাসগুলোতে রাজনীতিমুক্ত হোক আর ছাত্রসংসদ চালু হোক।
উর্মিলা প্রীতি বলেন, আন্দোলনের আগে আমি আওয়ামীলীগের আমলে বৈষম্যের শিকার হয়েছি। নানাভাবে হুমকি খেয়েছি, নির্যাতিত হয়েছি। এখন আন্দোলনের পর আমি প্রকাশ্যে কথা বলতে পারি, এটাই এখন আমাদের আন্দোলনের স্বার্থকতা। আমার আন্দোলনের শুরু ১২ জুলাই৷ তখন ভিক্টোরিয়া কলেজ ছাত্র তামিমের উপর নির্যাতন চালানো হয়। এরই সূত্র ধরে, আমরা ১৩ তারিখ আমাদের পরীক্ষা বয়কট করি। আর বয়কটের মধ্য দিয়েই আমার আন্দোলনের শুরু। ভিক্টোরিয়া কলেজ ছিলো একটি ছাত্রলীগভিত্তিক ক্যাম্পাস৷ সেখানে আন্দোলন করা বিশেষ করে ছাত্রীদের জন্য অনেক কঠিন ছিলো৷ এরপর, ছাত্রলীগের কর্মীরা আমাদেরকে নানাভাবে হেনস্থা করেছিলো৷ তখন আমাদের ক্লাসমেটরাও আমাদেরকে মারতে এসেছিলো। আমরা ৪/৫ জন মেয়ে ছিলাম, যারা পরীক্ষা বয়কট করেছিলাম। তখন ভয় কাজ করেছিলো অনেক। বড় ভাইয়েরা আমাদেরকে তেড়ে আসছিলো মারতে। আমাদেরই সহপাঠী বেল্ট দিয়ে আমাদেরকে মারতে আসে। আমাদেরকে সবার সামনে ক্যাম্পাস থেকে বের করে দিয়েছিলো। তখনই প্রতিজ্ঞা নিয়েছিলাম আন্দোলন করে যাবো। ৩ আগষ্ট আমি প্রথমে ভেবেছিলাম জিলা স্কুলে যাবো। সেখানে গিয়ে দেখি ২০০/৩০০ হেলমেট বাহিনী দাঁড়িয়ে ছিলো৷ তখন আমি কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সাথে পূবালী চত্ত্বরে যোগ দিই৷ তখন আমরা মিছিল দিতে শুরু করলে আমাদেরকে ছাত্রলীগের কর্মীরা গুলি করে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। তখন আমি ছাত্রলীগের ধাওয়া খেয়ে পুলিশ লাইনে এসে যোগ দিই। তখন এক দেড় ঘণ্টা পর আমাদের উপর ছাত্রলীগ পুলিশ লাইনে হামলা চালায়। যা পুরো বিশ্ব দেখেছে। আমি আগামীতে এমন একটি দেশ চাই যেখানে আমরা নিরাপদে থাকবো। আমি প্রথমেই বলেছিলাম, আমি ছাত্রলীগের হাতে নির্যাতিত হয়েছিলাম, এটা থেকে বাঁচতে হলেও আমি ক্যাম্পাসে ছাত্রসংসদ চালু হোক এটা চাই৷