বর্ষাকালে কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে চর্মরোগের প্রকোপ বাড়ে বলে জানিয়েছেন বিশিষ্ট চর্ম,যৌন ও কুষ্ঠরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মো. আজিজুর রহমান সিদ্দিকী। সোমবার (১৯ মে) রাতে ‘চর্ম, যৌন, এলার্জি ও কুষ্ঠরোগ প্রেক্ষিত কুমিল্লা’ বিষয়ক টকশো এক টকশো তে এসব বলেন তিনি। মিশন হাসপাতাল প্রা. লি. এর সৌজন্যে দৈনিক আমাদের কুমিল্লা ও জনপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল কুমিল্লার জমিনের যৌথ উদ্যোগে ১৯৫তম পর্বের এ টক শো অনুষ্ঠিত হয়। সাংবাদিক, সংগঠক ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক লেখক শাহাজাদা এমরানের সঞ্চালনায় টকশোতে অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ডা. মো. আজিজুর রহমান সিদ্দিকী ।
এসময়, টকশোতে চর্ম রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, শীতকালের তুলনায় বর্ষা ও গ্রীষ্মকালে চর্মরোগের প্রকোপ বেশি দেখা যায়। সাধারণত খোসপাঁচড়া, দাঁদ, স্ক্যাভিক্সসহ বিভিন্ন ত্বকের সমস্যায় মানুষ এই সময় বেশি ভোগে। শিশু, বৃদ্ধ এবং গর্ভবতী নারীরা এ রোগে বেশি আক্রান্ত হন। রোগ প্রতিরোধে তিনি ঠান্ডা ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পরিবেশে থাকার পরামর্শ দেন।
চর্মরোগ প্রতিকারে ওষুধের প্রয়োজনীয়তা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, স্ক্যাভিক্স বা দাঁদের মতো রোগে আক্রান্ত হলে নির্দিষ্ট ওষুধ গ্রহণ করতেই হয়। তবে এসব রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব যদি সচেতনতা এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অভ্যাস গড়ে তোলা যায়। স্ক্যাভিক্সের ক্ষেত্রে শিশু ও গর্ভবতী নারীদের জন্য আলাদা ধরণের ক্রিম ও লোশন ব্যবহার করা হয়। রোগের উপসর্গ দীর্ঘদিন চললে ইনফেকশন দেখা দেয়, তখন অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ করতে হয়। অনেক সময় সময়মতো চিকিৎসা না নিলে রোগ জটিল আকারও ধারণ করে।
রোগ প্রতিরোধে সচেতনতা বাড়ানোর ওপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা এড়িয়ে চলা, বাসা-বাড়ি পরিচ্ছন্ন রাখা এবং এয়ার কুলার ব্যবহার করা যেতে পারে। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে নিয়মিত গোসল করা। কারণ স্ক্যাভিক্সের জীবাণু ঘর্মাক্ত শরীর থেকে পুষ্টি সংগ্রহ করে এবং এটি শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। এই জীবাণু ৬ থেকে ৮ সপ্তাহ বেঁচে থাকতে পারে। তাই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা জরুরি। যেসব বাসায় অতিরিক্ত লোকজন থাকে সেখানে সবার জন্য পর্যাপ্ত জায়গা থাকা উচিত, নইলে সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ে। তিনি জানান, অনেক সময় জীবাণু ধ্বংস হয়ে গেলেও কিছুদিন পর্যন্ত চুলকানি থাকতে পারে, তবে এতে হতাশ হওয়ার কিছু নেই।
সরকারি উদ্যোগ প্রসঙ্গে ডা. আজিজুর রহমান সিদ্দিকী বলেন, সরকার পুরোপুরি চিকিৎসা দিতে না পারলেও কিছু ওষুধ সরবরাহ করছে। তবে অনেক ওষুধ বাহির থেকেও কিনতে হয়। তিনি এই ব্যাপারে সরকারি সহযোগিতার পাশাপাশি ব্যক্তিগত সচেতনতার ওপর গুরুত্ব দেন।
কুষ্ঠ রোগ প্রসঙ্গে তিনি জানান, বাংলাদেশে প্রতি বছর চার হাজারের বেশি কুষ্ঠ রোগী শনাক্ত হয়। এটি একটি ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগ এবং ছোঁয়াচেও বটে। তবে আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে এলেও ৯৫ শতাংশ মানুষের এ রোগ হয় না। মূলত দারিদ্র্যপীড়িত মানুষদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকার কারণে তারা বেশি আক্রান্ত হন। দরিদ্রদের মধ্যে অপুষ্টি ও খাদ্যাভ্যাসের ঘাটতির কারণেই এমন সমস্যা দেখা দেয়।
চর্মরোগ চিকিৎসার একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা ডার্মাটোসার্জারী নিয়ে কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, এটি একটি সার্জারি প্রক্রিয়া হলেও তুলনামূলকভাবে ছোটখাটো অস্ত্রোপচার এতে করা হয়। পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের থেরাপি ও লেজার ট্রিটমেন্ট এখানে দেওয়া হয়, যা বিউটিফিকেশন কিংবা মেছতা, ব্রণ, চুল পড়া ইত্যাদির চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। এসব ক্ষেত্রে সাধারণত অ্যানেস্থেসিয়ার প্রয়োজন হয় না।
চুল পড়া নিয়ে প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বর্তমান প্রযুক্তিনির্ভর জীবনে মোবাইল ফোন ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অতিরিক্ত ব্যবহার, অনিদ্রা ও অনিয়মিত জীবনযাপন চুল পড়ার অন্যতম কারণ। হরমোনজনিত পরিবর্তন ছাড়াও জন্মগত বা বংশগত কিছু কারণেও এই সমস্যা দেখা দিতে পারে। একইভাবে অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাস, ভেজাল খাবার ও কম ঘুমের ফলে অনেকের অল্প বয়সে চুল পেকে যেতে দেখা যায়।
যৌন রোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, যৌন রোগ সবসময় ছিল এবং এখনো আছে। এটি মূলত দুই ধরনের সেক্সুয়ালি ট্রান্সমিটেড ডিজিজ ও সেক্সুয়াল ডিসঅর্ডার। অনিয়মিত জীবনধারণের ফলে সেক্সুয়ালি ট্রান্সমিটেড রোগের হার বেড়েছে। অপরদিকে, সেক্সুয়াল ডিসঅর্ডার আক্রান্তরা বিষয়টি লুকিয়ে রাখতে চান এবং এ কারণে তারা অনেক সময় অপচিকিৎসার শিকার হন। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ না নিয়ে নানা ঝুঁকিপূর্ণ চিকিৎসা নেওয়ার ফলে এসব রোগ জটিল আকার ধারণ করতে পারে। তিনি বলেন, এই রোগগুলো সম্পর্কে সচেতনতা এবং যৌনশিক্ষার অভাব থাকায় এখনো অনেকেই এসব নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করতে চান না।
ফরমালিনযুক্ত খাবার নিয়ে তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, অধিকাংশ মানুষ বুঝতেই পারে না যে তারা ক্ষতিকর কেমিক্যালযুক্ত খাবার খাচ্ছেন। দীর্ঘ মেয়াদে এসব খাবার লিভার ও কিডনির জটিল রোগের জন্ম দেয়। বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় দুই কোটিরও বেশি মানুষ লিভার রোগে আক্রান্ত। তাই ফরমালিনযুক্ত ফল ও খাবার থেকে দূরে থাকা জরুরি। দেশীয় মৌসুমি ফলের দিকে নজর দিতে হবে আমাদের।
ফরমালিনযুক্ত ফল চেনার উপায় জানাতে গিয়ে তিনি বলেন, কোনো ফল ৩০ মিনিট পানিতে ভিজিয়ে রাখলে যদি পানি কালচে হয়ে যায়, তাহলে ধরে নেওয়া যেতে পারে তাতে ফরমালিন আছে। এভাবে কিছুটা হলেও প্রভাব কমানো যায়। আম বা অন্য ফল পাড়ার কমপক্ষে দুই সপ্তাহ আগে কীটনাশক প্রয়োগ বন্ধ করতে হবে এবং প্রশাসনকে এ বিষয়ে কঠোর নজরদারি করতে হবে।
বর্ষাকালে বাড়তি কিছু রোগ ছড়ায় বলেও তিনি জানান। এর মধ্যে রয়েছে স্ক্যাভিক্স, দাঁদ, ক্যান্ডিডিয়াসিস (আঙুলের ফাঁকে ক্ষত), ঘামাচি ও শরীরে পাকা গোটা ওঠা ইত্যাদি। এসব রোগ থেকে বাঁচতে প্রয়োজন যথাযথ পরিচ্ছন্নতা, সঠিক জীবনযাপন এবং রোগপ্রতিরোধমূলক অভ্যাস গড়ে তোলা।
চর্মরোগকে অবহেলা না করে সময়মতো সঠিক চিকিৎসা নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে ডা. মো. আজিজুর রহমান সিদ্দিকী বলেন, নিয়মিত পরিচ্ছন্নতা ও সচেতনতা থাকলে অনেক রোগ থেকেই সহজেই মুক্তি পাওয়া সম্ভব। পাশাপাশি সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে যৌথ উদ্যোগের মাধ্যমে চর্মরোগের বিস্তার প্রতিরোধ করা যেতে পারে।
সর্বশেষ ডেঙ্গু রোগ প্রসঙ্গে ডা. আজিজ বলেন, এটা ভাইরাসজনিত রোগ। এডিস মশা এই রোগ ছড়ায়। এটাও পরিবেশজনিত সমস্যার কারণে হয়। এই রোগ হলে প্রচন্ড জ্বর, গিরায় গিরায় ব্যাথা হয়। কোথাও পানি জমে থাকলে সেখানে এডিস মশা হয়। তাই, নিয়মিত মশারি ব্যবহার কারতে হবে, সতর্ক থাকতে হবে। এই রোগ হলে অনুচক্রিকা কমে যায়। তাই ডেঙ্গু হলে কোনো খামখেয়ালি না করে অবশ্যই চিকিৎসা নিতে হবে।