দুর্ভিক্ষ কি দড়জায় কড়া নাড়ছে ? -শাহাজাদা এমরান

সময়ের কড়চা
স্টাফ রিপোর্টার
প্রকাশ: ১ বছর আগে

গত ৪ নভেম্বর ২০২২ শুক্রবার গিয়েছিলাম সিলেটে এপেক্স বাংলাদেশের জেলা ৪ এর একটি অনুষ্ঠানে। অনুষ্ঠানের এক পর্যায়ে নিরভানা ইন হোটেলে মৌলভী বাজার ও সুনামগঞ্জ জেলার কয়েকজন এপেক্সিয়ান বন্ধুর সাথে কথা বলছিলাম। সবাই নিজ নিজ জেলার বিভিন্ন পেশাজীবী সম্প্রদায়ের নেতা। সবার আলোচনাতেই কমন একটি বিষয় উঠে এলো আচ্ছা , দেশে কি সত্যিই দুর্ভিক্ষ আসবে। ডিসেম্বর পর কি হবে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন। আওয়ামীলীগ কি পারবে বিএনপি তথা বিরোধী দলের আন্দোলন সামাল দিতে কিংবা বিএনপি কি পারবে আওয়ামীলীগের মত শক্তি শালী একটি দলের বিরুদ্ধে এক দফার আন্দোলনে গিয়ে সফল হতে।
যেহেতু উপস্থিত বন্ধুদের মধ্যে আমি সবচেয়ে কম জানি এবং কম বুুঝি তাই সুবোধ বালকের মত তাদের জ্ঞান গর্ব কথা গুলো মনোযোগ দিয়ে শুনছিলাম। এক পর্যায়ে সবার প্রশ্নের একমাত্র উত্তরদাতা হয়ে গেলাম আমি। বন্ধু আবদুল হালিম বলল, আচ্ছা এমরান ভাই, আপনিতো সাংবাদিক । আচ্ছা বলেন তো, এই যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কিছুদিন আগে ইংগিত দিলেন দেশে দুর্ভিক্ষ আসতে পারে। দিন দিন নিত্য প্রয়োজনীয়সহ সকল দ্রব্যমূল্য অস্বাভাবিক ভাবে বেড়ে চলছে। ক্রয় সীমার বাহিরে চলে যাচ্ছে সব কিছু। আসলে বিষয়টা কি ?
আমি বিনয়ের সাথে জানালাম, আপনারা এখানে নিজ নিজ জেলায় কেউ আওয়ামীলীগ বা বিএনপির রাজনীতির সাথে জড়িত। আবার কেউ আছেন ব্যবসায়ী এবং আইনজীবী নেতা ।সুতরাং সাংবাদিকরা তো আর আলাদা গ্রহের কোন মানুষ না। এই সমাজেরই একটি অংশ। আপনারা যেভাবে ভাবছেন আমার ভাবনা তো আর আকাশ পাতাল ব্যবধান হওয়ার কথা না।
পরে বিকালে সিলেটের জিন্দা বাজারে একটি দোকানে বসে ডাল পুরি খাচ্ছিলাম। পুরির সাইজ ছোট , দাম আবার দশ টাকা – কারণ জানতে চাইলেন কুমিল্লার এপেক্সিয়ান বন্ধু ওয়ালি উল্লাহ রিপন। দোকানদার আমির হামজা জানালেন, এই পুরিটি দুই মাস আগেও পাঁচ টাকা রেখেছি। বর্তমানে বিক্রি করছি দশ টাকা। বর্তমান অবস্থা অব্যাহত থাকলে আগামী মাসে এই পুরি খেতে হবে পনের টাকা দিয়ে।ব্যবসার অবস্থা খুব খারাপ জানিয়ে হামজা বললেন, ভাই বেশি দামে মাল কিনে আনি। তাই কিছুটা দাম বাড়িয়ে বিক্রি করতে হয়। কিন্তু আগের মত কাস্টমার খায় না। যারা আগে এক বসাতেই চার পাঁচটা পুরি খেত তারা এখন দুই একটা খায়। মানুষের হাতে টাকা নেই। দেশের অবস্থা ভালো না। সামনে মনে হয় ভয়াভহ দুর্ভিক্ষ টুর্ভিক্ষ আসতে পারে , জানি না। আমাদের মত গরিবদের না খেয়ে মরতে হবে।
৬ নভেম্বর ২০২২ রোববার গিয়েছিলাম মুন্সিগঞ্জের গজারিয়া উপজেলার মফিজ উদ্দিন সরকার মডেল মাদ্রাসা ও এতিমখানায়। সমাজের দশ জনের সহযোগিতা নিয়ে মাদ্রাসা ও এতিমখানাটি আমরা পরিচালনা করে আসছি। সেপ্টেম্বর মাসে মাদ্রাসার বোর্ডিংয়ে খাবার বাবদ যে টাকা খরচ হয়েছে, গেল অক্টোবর মাসে একই পরিমান শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের জন্য খরচ হয়েছে প্রায় ২০ হাজার টাকা বেশি। জানতে চাইলাম এত টাকা এই মাসে কেন বেশী হলো।খাওয়া ধাওয়া কি বেশি হয়েছে। মাদ্রাসার সুপার ও সেক্রেটারি সাহেব সব খরচের ভাউচার উপস্থাপন করে বলল, সেপ্টেম্বর থেকে অক্টোবর মাসে মাছ মাংসের পরিমান কমিয়ে দেয়ার পরও খরচ বেড়ে গেছে। চলতি নভেম্বর মাসে এই খরচ আরো বাড়বে। যদি না , জিনিস পত্রের দাম না কমে।
মাদ্রাসায় যাওয়ার সময় সব সময়ই আমি ছাত্রদের জন্য কিছু না কিছু নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি। এবার পাউরুটি আর কলা নিলাম। গেল মাস থেকে এবার দেখলাম প্রতি পাউরুটির দাম দশ টাকা বেশি। পাঁচ টাকার কলার দাম আট টাকা। কলা ব্যবসায়ী জানান, আমরা মুন্সিগঞ্জ শহর থেকে কলা আনি। গত পনের দিনে আড়তে কলার দাম তো বাড়ছেই আমাদের স্থানীয় পরিবহন ব্যয়ও বেড়ে গেছে।
ঢাকা চট্রগ্রাম মহাসড়কের মেঘনা ব্রিজ সংলগ্ন জামালদি বাস স্ট্যান্ড থেকে গেল মাসে ইঞ্জিন চালিত অটো গাড়ি রিজার্ভ নিয়ে মাদ্রাসায় গিয়েছি ত্রিশ টাকা দিয়ে । আজ সেই অটো রিক্সা জানাল স্যার এখন থেকে আমরা পঞ্চাশ টাকা নেই। বিশ টাকা কেন বাড়ালে জানতে চাইলে চালক রহিম শেখ জানাল, স্যার, জিনিস পত্রের যেই দাম মালিকের ভাড়া দিয়ে পাঁচ জনের সংসারের তিন বেলার খাবারের টাকা উঠাতে পারি না। আগে যখন জনপ্রতি পাঁট টাকা নিতাম তখন প্যাসেঞ্জার বেশি ছিল। এখন দশ টাকা হওয়াতে অনেক মানুষ হেঁটেই চলে যায়। কি করবে মানুষের ব্যয় বাড়ছে স্যার, আয় তো বাড়েনি।
মাদ্রাসা থেকে আসার পথে মাদ্রাসার সেক্রেটারি ও আমার অগ্রজ আবরারুল হক সরকার শরীফ ভাই বলল, আজ (৬ নভেম্বর ২২) থেকে আগামী ৬ দিন আমাদের মেঘনা পাড় সকাল ৮টার পর থেকে গ্যাস থাকবে না। গ্যাস ছাড়া এখানকার গ্যাস নির্ভর ব্যবসায়ীরা চলবে কিভাবে। এখানকার হোটেল রেস্তোরা যদি এ সময় সিলিন্ডা গ্যাস ব্যবহার করে তাহলে তো দাম বেড়ে যাবে দ্রব্য মূল্যের। মানুষ খাবে কি। তোমরা সাংবাদিকরা লিখতে পার না পত্রিকায়।
বড় ভাইয়ের কথা শুনে মনে মনে হাসলাম, কুষ্টিয়া,রাজবাড়ি থেকে সিলেট এরপর মুন্সিগঞ্জ। সব জায়গাতেই কমন কথা, সাংবাদিকরা লিখে না কেন। সাংবাদিকরা লিখলে না কি দাম কমবে। অর্থাৎ তারা মনে করে জগতের সব জান্তা হলো সাংবাদিকরা ! আসলে কি তাই ?
মেঘনা পাড় থেকে কুমিল্লার উদ্দেশ্যে ঢাকা চট্রগ্রামের এক বাসে উঠলাম। পাশের সিটের যাত্রীর পরিচয় নিয়ে জানলাম তিনি চট্রগ্রাম ফায়ার সার্ভিসে চাকুরি করেন। আমার পরিচয়ও নিলেন। বাড়ি তার নারায়নগঞ্জ। ছুটি শেষ করে এখন কর্মস্থলে যাচ্ছেন। আলাপের এক পর্যায়ে জানতে চাইলেন, আচ্ছ ভাই, দুর্ভিক্ষটা সম্ভবত কখন আসতে পারে। বাড়িতে বাবাকে বলে এসেছি, কষ্ট করে হলেও আট/দশ বস্তা চাল কিনে রাখতে। ঘরে ভাই চাল থাকলে আর কোন চিন্তা নেই। বললেন, আচ্ছা সাংবাদিক ভাই, আমাদের প্রধান মন্ত্রীর মুখ দিয়ে দুর্ভিক্ষের কথাটা না বললেই মনে হয় ভালো হতো। কারণ, স্বয়ং প্রধান মন্ত্রীর মুখে এ কথা শুনে মানুষের মনে এক ধরনের ভয় ধরে গেছে। যার কারণে মনে হয় জিনিস পত্রের দাম কমছে না। আমি বললাম, প্রধানমন্ত্রী কিন্তু আমাদের আগাম প্রস্তুতি নিয়ে রাখার জন্য সতর্ক থাকার জন্য বলেছেন। বর্হিবিশে^র অবস্থান ব্যাখ্যা করেছেন, দুৃর্ভিক্ষ হবেই এমন কথা কিন্তু তিনি বলেননি। কিন্তু আমার এই দৃঢ় যুক্তি তিনি মানতে নারাজ। তার সার কথা হলো, দায়িত্বশীল জায়গায় থেকে ইচ্ছে করলেই সব কথা বলা যায় না ভাই। উদাহরণ স্বরুপ কয়েকটি কথাও বললেন।
মুন্সিগঞ্জ থেকে আসার পথে বাস যোগে নামলাম আলেখারচর বিশ^রোডে। গেল সপ্তাহে আলেখারচর থেকে পুলিশ লাইনের সিএনজি ভাড়া ছিল বিশ টাকা। আজ (৬ নভেম্বর ২২) ভাড়া নিল ২৫ টাকা। চালক জানাল খরচ বেড়েছে স্যার।
গত ১৫ দিনের ব্যবধানে দেশের প্রায় ৭/৮টি জেলায় গিয়েছি। যার সাথেই কথা বলেছি কিংবা কথা শুনেছি কম বেশ সবার মধ্যেই একটি কথা , ভাই, সত্যিই কি দুর্ভিক্ষ আসতেছে। দুর্ভিক্ষ আসলে কবে আসতে পারে। কি অবস্থা হবে আমাদের মত নিম্ম আয়ের মানুষের, ইত্যাদি নানা কথা বাজারে ভেসে বেড়ায় এখন দুর্ভিক্ষ নিয়ে।
সারা দিন ক্লান্ত অবসান্ত মন নিয়ে যখন অফিসে এলাম, তখন অফিসের সামনের ডাব বিক্রেতা সুমন এসে জানাল, স্যার, আগে যে ডাব ৫০/৬০ টাকায় বিক্রি করতাম এখন সেই ডাব ৮০/১০০ টাকায় বিক্রি করেও লাভ করতে পারি না। খুব কষ্ট হয় চলতে। আপনার অফিসে কোন চাকুরি আছে নি স্যার।
বিভাগ থেকে জেলা, জেলা থেকে উপজেলা, উপজেলা থেকে ইউনিয়ন, ইউনিয়ন থেকে ওয়ার্ড, ওয়ার্ড থেকে পাড়া , পাড়া থেকে বাড়ি. বাড়ি থেকে ঘর সব জায়গায়ই একই আওয়াজ সত্যিই কি আমরা দুর্ভিক্ষের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। দুর্ভিক্ষ কি আমাদের দড়জায় এসে কড়া নাড়ছে ?
আমি বিশ^াস করি, সমস্যা যত গভীর হোক না কেন সমাধানও একটা বেড়িয়ে আসবে। বিশ কোটি জনসংখ্যার দেশে ৪০ কোটি হাত আছে। একা সরকারের দিকে চেয়ে থাকলে হবে না। আবার সরকারের ভুমিকা ছাড়া বর্তমান অবস্থা থেকে উত্তরণও সম্ভব না। দেশের মানুষের মধ্যে দুর্ভিক্ষ নিয়ে যে উদ্বেগ, উৎকন্ঠা রয়েছে সরকারেরই দায়িত্ব দ্রব্যমূল্যের দাম নিয়ন্ত্রনের মধ্যে এনে দেশের জনগনকে শঙ্কা মুক্ত করা।
আমরা সরকারের কাছে আশ^স্ত হতে চাই, আমরা দুর্ভিক্ষ কবলিত জাতিতে পরিনত হবো না। বেঁচে থাকার জন্য নূন্যতম যে অধিকার গুলো সংবিধান আমাদের দিয়েছে সেই অধিকার গুলো নিরাপদে,নিশ্চিন্তে ক্রয় সীমার মধ্যে আমরা পেতে চাই। কড়া নাড়া দুর্ভিক্ষ যেন বাহিরেই থাকে । দড়জা খুলে ভিতরে যেন আসতে না পারে , মহান আল্লাহর কাছে সেই ফরিয়াদ করি।

লেখক : ব্যবস্থাপনা সম্পাদক,দৈনিক আমাদের কুমিল্লা ও সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ সাংবাদিক সমিতি,কুমিল্লা জেলা।
মোবাইল : ০১৭১১-৩৮৮৩০৮
sahajadaamran@yahoo.com.