দেশের তৃতীয় উদ্ভিদ উদ্যান কুমিল্লার লালমাই পাহাড়ে

# কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতার কারণে বিরল এই উদ্ভিদ উদ্যানটি এখনো সাধারণের কাছে অজানাই রয়ে গেছে
স্টাফ রিপোর্টার
প্রকাশ: ১ বছর আগে

লাল মাটির পাহাড়েই গড়ে উঠেছে উদ্ভিদ উদ্যানটি। অনেকটা উঁচু-নিচু প্রকৃতির পাহাড়টির মাথায় তৈরি করা হয়েছে ইট দিয়ে বিছানো পথ। ইটের পথ ধরে হাঁটতেই একটু পরপরই দেখা মিলবে- বিরল ও বিপন্ন প্রজাতির উদ্ভিদের। পথের দুই পাশে থাকা এসব উদ্ভিদের সঙ্গে রয়েছে পরিচিতি বোর্ডও। সেখানে চোখ গেলেই পাওয়া যাবে উদ্ভিদের নাম-পরিচয়সহ বিস্তারিত বর্ণনা। কিছুটা দূর পর্যন্ত গেলে চোখে পড়বে প্রায় বিলুপ্ত হওয়া বিভিন্ন প্রজাতির বাঁশ ঝাড়ও। আছে রঙ-বেরঙের নানান ধরণের ফুলের সমারোহ। রয়েছে ক্যাকটাস ও অর্কিড হাউসও। কিন্তু কর্তৃপক্ষের উদাসীনতার কারণে বিরল এই উদ্ভিদ উদ্যানটি এখনো সাধারণের কাছে অজানাই রয়ে গেছে।

দর্শনার্থীদের এমন নান্দনিক দৃশ্যই এখন চোখে পড়বে কুমিল্লার পর্যটন নগরী খ্যাত কোটবাড়ি এলাকার লালমাই উদ্ভিদ উদ্যানে গেলে। বর্তমান প্রজন্ম ভুলতে বসেছে এমন বিরল প্রজাতির উদ্ভিদ সংরক্ষণের উদ্যোগে হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে এই উদ্যানটি।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, বিরল এই উদ্ভিদের মেলা প্রতিনিয়তই মুদ্ধতা ছড়িয়ে যাচ্ছে দর্শনার্থীদের মধ্যে। এই উদ্ভিদ উদ্যানের ইটের পথ ধরে সবুজের মাঝে হাঁটতে হাঁটতে শরীরের সব ক্লান্তি যেন নিমিষেই শেষ হয়ে যায়। আর পাখির কিচিরমিচির শব্দতো রয়েছেই। সবুজ প্রকৃতি আর পাখির শব্দ শুনে বাড়ি ফিরতে মন চাইবে না দর্শনার্থীদের।
কুমিল্লা নগরীর ২৪ নম্বর ওয়ার্ডের কোটবাড়ি ময়নামতি জাদুঘরের কাছে সালমানপুর নামক স্থানে প্রায় ১৭ একর জায়গা জুড়ে গড়ে তোলা হয়েছে উদ্যানটি। এখানে রয়েছে কয়েক শ’ প্রজাতির উদ্ভিদ। যার অন্তত ৯০ শতাংশই বিপন্ন ও দ্রুষ্প্রাপ্য প্রজাতির উদ্ভিদ বলে জানিয়ে কুমিল্লা সামাজিক বন বিভাগ কর্তৃপক্ষ। ভবিষ্যতে এ উদ্যানটির বিস্তৃতি আরও বাড়াতে চান তাঁরা।
কুমিল্লা সামাজিক বন বিভাগে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমান প্রজন্ম ভুলতে বসেছে এমন বিরল প্রজাতির উদ্ভিদ সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছে সামাজিক বন বিভাগ। ঢাকার মিরপুর ও চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের পর লালমাই উদ্ভিদ উদ্যানটি দেশের তৃতীয় বিরল উদ্ভিদ উদ্যান। ২০১৫ সালে এটির কাজ শুরু হয়ে ২০২০ সালের শুরুতে শেষ হয়। ওই বছরের ৭ নভেম্বর দর্শনার্থীদের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয় বিরল উদ্ভিদের এই উদ্যানটি। এ উদ্যানের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে বিরল প্রজাতির উদ্ভিদ সংরক্ষণ, বন্য প্রাণীর নির্ভয় আবাসস্থল তৈরি, শিক্ষা ও গবেষণার সুযোগ সৃষ্টি করা। এছাড়া বিনোদনের ব্যবস্থা ও স্থানীয়দের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা। বর্তমান উদ্যানের নিকটবর্তী বনবিভাগের ৩০ একরের মতো প্রাকৃতিক শালবাগান রয়েছে। মাঝে আরও প্রায় ৩০ একর ভূমি অধিগ্রহণ করা সম্ভভ হলে লালমাই উদ্ভিদ উদ্যানটি অনেক সম্মৃদ্ধ হবে। যদিও এখনো এই প্রক্রিয়া শুরু করা সম্ভব হয়নি।
সরেজমিনে গিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে উদ্যানটিতে বিলুপ্তপ্রায় ও বিরল উদ্ভিদের মধ্যে রাধাচূড়া, নাগেশ্বর, আগার, নাগলিঙ্গম, কাঞ্চন, অশ্বথ, চন্দন, রক্তচন্দন, চালমুগরা, লোহাকাঠ, চাপালিশ, ধূপ, বাবলা, হরিতকি, বহেরা, হিজল, কনক, তমাল, অশোক, সিভিট, উড়ি আম, বন পেয়ারা, অর্জুন, মহুয়া, তেলশুর, পুঁটিজাম, বাঁশপাতা, কুম্ভি, পিতরাজ, পারুল, জারুল, চম্পা, টগর, বেলি, চিকরাশি, হরিয়ান, লটকন, ফেন্স, বোটলব্রাশ, বাসক, রঙ্গন, করমচা, সোনালু, বট ও কৃষ্ণচূড়াসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ রয়েছে সমাহার রয়েছে। এই উদ্ভিদ উদ্যানে রয়েছে ক্যাকটাস হাউস, অর্কিড হাউস, বিভিন্ন ফুলের বাগান, বিরল উদ্ভিদ বাগান, বন্যপ্রাণীর জন্য জলাশয়, বিভিন্ন প্রজাতির ঘাস। এখানে দর্শনার্থীদের বসার জন্য নির্মাণ করা হয়েছে বেশ কিছু আরসিসি বেঞ্চ, ব্যাঙের ছাতা সদৃশ্য বিশ্রামাগার। নির্মাণ করা হয়েছে পৃথক শৌচাগারও।
২০২০ সালের ৭ নভেম্বর উদ্যানটির উদ্বোধন করে বন বিভাগের প্রধান বন সংরক্ষক মো.আমীর হোসেন চৌধুরী জানিয়েছিলেন, এখানে দেশের প্রথম ফরেস্ট মিউজিয়াম গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে তাঁদের। উদ্যানটিকে জাতীয় মানের একটি উদ্যান হিসেবে গড়ে তুলতে মন্ত্রণালয় একটি মাস্টারপ্লান প্রণয়ন করেছে। এছাড়া উদ্যানটির সম্প্রসারণের কাজ চলমান রয়েছে। এটি পূর্ণাঙ্গভাবে প্রতিষ্ঠিত হলে পুরো দেশবাসী বিনোদনের পাশাপাশি শিক্ষা ও গবেষণার কাজ করতে পারবেন এখানে। এই উদ্যোনের ৯০ ভাগ উদ্ভিদই বিরল এবং বিলুপ্ত প্রায় প্রজাতির। এসব উদ্ভিদ আগামী প্রজন্মের জন্য কাজে আসবে। আর কুমিল্লাবাসীর ফুসফুস হিসেবে কাজ করবে এই উদ্যানটি।
উদ্বোধনের দুই বছর পার হলেও সম্প্রতি সরেজমিনে ঘুরে তেমন কোন পরিবর্তন দেখা যায়নি। উদ্যানটিতে প্রবেশের ক্ষেত্রে অপ্রাপ্তবয়স্ক ও শিক্ষার্থীদের জন্য টিকিট ৫ টাকা, প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য ২০ টাকা এবং বিদেশিদের জন্য ৪০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকে এই উদ্যান।
উদ্বোধনের দুই বছর পার হলেও এখনো দর্শনার্থীদের কাছে উদ্যানটি খুব বেশি পরিচয় হয়নি বলে মনে করেন এখানে ঘুরতে আসা জেলার মনোহরগঞ্জের মাদ্রাসা শিক্ষক আবুল কালাম আজাদ। তিনি বলেন, এখানে যেসব গাছ আছে, তা এখন খুব একটা দেখা যায় না। গাছগুলো আসলেই বিরল। এই উদ্যানটি বর্তমান প্রজন্মকে ভুলতে বসা অনেক প্রজাতির গাছকে পরিচিত করে তুলবে। তবে আমি ঘুরতে গিয়ে দেখেছি দর্শনার্থীদের সংখ্যা খুব বেশি না। উদ্যানটিকে পরিচিত করে তুলতে সামাজিক বন বিভাগকে আরো উদ্যোগ নিতে হবে।
ঘুরতে আসা আরেক দর্শনার্থী তাহমিনা ইসলাম সাথী বলেন, উদ্যানটি ঘুরলে নতুন প্রজন্ম হারিয়ে যাওয়া অনেক উদ্ভিব সম্পর্কে ভালো ধারণা পাবে। বিশেষ করে অনেক ঔষুধী গাছ রয়েছে উদ্যানটিতে; যা এখন আর গ্রামেও দেখা যায় না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন শিক্ষা সফর এখানে হতে পারে। তাহলে নতুন প্রজন্ম বেশি উপকৃত হবে।

লালমাই উদ্ভিদ উদ্যানটি পরিপাটি করে গড়ে তোলা হয়েছে বলে জানিয়েছেন কুমিল্লা সামাজিক বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মোহাম্মদ আলী। তিনি বলেন, এই উদ্যানে রয়েছে বসে অবসর কাটানোর সুযোগ। এই উদ্যান নতুন প্রজন্মকে বিরল প্রজাতির উদ্ভিদ সম্পর্কে ধারণা দেবে। চালু হওয়ার পর করোনার কারণে দর্শনার্থীদের পদচারণা কিছুটা কমে গেলেও এখন ধীরে ধীরে তা বাড়ছে। উদ্যানটিকে সম্মৃদ্ধ করতে আমাদের বিভিন্ন পরিকল্পনা আছে। আশা করছি দ্রুত সময়ের মধ্যে লালমাই উদ্ভিদ উদ্যানটি দেশের অন্যতম সেরা বিরল উদ্ভিদের উদ্যানে পরিণত হবে।