নাঙ্গলকোট উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান কালু ৫শ কোটির টাকার মালিক

গত ১৫ বছর আওয়ামী লীগের ক্ষমতার পুরোটা সময় তিনি ব্যস্ত ছিলেন লুটপাটে
স্টাফ রিপোর্টার
প্রকাশ: ২ সপ্তাহ আগে

 

কুমিল্লার নাঙ্গলকোটের ‘গডফাদার’ সামছুদ্দিন কালু জেলার শীর্ষ লুটেরা হিসাবে সাধারণ মানুষের কাছে চিহ্নিত। তিনি নাঙ্গলকোট উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান, উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি।

 

আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না থাকলেও এখনো কালুর অদৃশ্য প্রভাব রয়েছে গোটা নাঙ্গলকোটে। বিএনপির একটি অংশ এবং স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে সুসম্পর্ক রয়েছে তার। ফলে তার আধিপত্য ও সাম্রাজ্যের ছায়ানিয়ন্ত্রণ অব্যাহত রয়েছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, নাঙ্গলকোট পৌর সদরের হাজী আলী আকবরের ছেলে সামছুদ্দিন কালু সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের অন্যতম সহযোগী। উপজেলা সদরের বাসিন্দা কালুর ছিল অস্ত্রেশস্ত্রে সমৃদ্ধ এক ক্যাডার বাহিনী। গোটা উপজেলার মানুষই ছিল তার কাছে জিম্মি। বিশেষ করে গুরু মুস্তফা কামালের আশীর্বাদ থাকায় ধরাকে সরা জ্ঞান করতেন তিনি। তাকে নাঙ্গলকোটের ‘সম্রাট’ও বলা হয়। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার আগে তিনি একজন মৎস্য ব্যবসায়ী ছিলেন। ক্ষমতা পাওয়ার পর উপজেলা আওয়ামী লীগ এবং অঙ্গসংগঠন ছিল তার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। তার কমিটি বাণিজ্য ছিল ওপেন সিক্রেট। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে মনোনয়ন বাণিজ্য, সরকারি জায়গা দখল, টিআর, কাবিখা লুট, টেন্ডারবাজি, তদবির বাণিজ্য, সব ধরনের উন্নয়ন প্রকল্প থেকে কমিশন আদায়, সালিশ দরবার ছিল তার আয়ের উৎস। অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে তিনি সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন।

 

 

আওয়ামী লীগের ক্ষমতার প্রভাবে বিতর্কিত এই গডফাদার কমপক্ষে ৫শ কোটি টাকা কামিয়েছেন। পূর্বে পৈতৃক কিছু সম্পদের মালিক থাকলেও আওয়ামী লীগের ক্ষমতা তাকে আঙুল ফুলে কলাগাছ বানিয়েছে।

সূত্র জানায়, রেলওয়ের মূল্যবান ৫ বিঘা জায়গা এই গডফাদারের দখলে রয়েছে। সেখানে দোকানপাট করে ভাড়া তুলে খাচ্ছেন। উপজেলা সদরের প্রাণকেন্দ্রে বিলাসবহুল বাড়ি নির্মাণ করেছেন। সরকারি বরাদ্দের টাকায় বাড়ির বাউন্ডারিসহ আশপাশ পাকা করেছেন। নাঙ্গলকোট আলট্রা মডার্ন হাসপাতাল ও নিজ বাড়ির পাশে রয়েছে পেট্রোল পাম্প। নাঙ্গলকোট সদরে কমপক্ষে ৭০ কোটি টাকা মূল্যের হাজী আলী আকবর সুপার মার্কেট। ১০ একর জায়গায় মৎস্য প্রকল্প। ছোট-বড় মিলিয়ে আরও ৪৭টি পুকুর। এর মধ্যে সরকারি সম্পদ দাউদপুর দীঘি, উপজেলা দীঘি, আদর্শ দীঘি, ভোলাইন দীঘিসহ ১৭টি সরকারি খাস দীঘি এবং পুকুর তার দখলে রয়েছে। এসব জলাশয় থেকে তিনি কোটি টাকা আয় করছেন।

পৌরসভার মান্দ্রা, হরিপুর, নাঙ্গলকোট মৌজা, গোত্রশাল, তুলা পুকুরিয়া, শ্রীকান্তা এলাকায় ১৫ একর মূল্যবান জমি রয়েছে তার। আমেরিকার নিউইয়র্ক শহরের জ্যাকসন হাইট এলাকায় তার একটি বিলাসবহুল বাড়ি রয়েছে। ঢাকার ইস্কাটন গার্ডেন সিটিতে আধুনিক অ্যাপার্টমেন্ট, উত্তরার প্রিয়াঙ্কা সিটিতে আধুনিক ৫ তলা ভবন, মোহাম্মদপুর নবোদয় হাউজিং প্রকল্পে তিনতলা ডুপ্লেক্স ভবন রয়েছে।

স্থানীয়দের দাবি, এসব সম্পদের বাইরেও কালুর আরও বিপুল অর্থবিত্ত রয়েছে। বিভিন্ন ব্যাংকে বিপুল পরিমাণ অর্থ রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে তিনি অনেক টাকা পাচার করেছেন বলে জানান এলাকার লোকজন।

পৌরসভার সাবেক কাউন্সিলর রেজাউল হক রেজু বলেন, ২০২১-২২ অর্থবছরে এডিবির অর্থায়নে ১৩৫টি বক্স কালভার্টের প্রকল্প আসে। কালু এসব কালভার্ট অর্ধেক কমিশন নিয়ে তার তিন সহযোগীর মাঝে ভাগ করে দেন।

উপজেলার হেসাখাল ইউপির ৮নং ওয়ার্ডের সদস্য কাজিম উদ্দিন বলেন, পুরো উপজেলার ইউপি সদস্য প্রার্থীদের কাছ থেকে দুই থেকে পাঁচ লাখ, চেয়ারম্যান প্রার্থীদের কাছ থেকে পাঁচ থেকে দশ লাখ টাকা করে উৎকোচ নিতেন কালু। নির্বাচনে প্রার্থী হলেই তাকে চাঁদা দিতে হতো।

কালু উপজেলার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সভাপতির দায়িত্বে থেকে করেছেন নিয়োগ বাণিজ্য। চডিয়া বাজার সিনিয়র আলিম মাদ্রাসার সহকারী শিক্ষক মাওলানা শফিকুল ইসলাম বলেন, চডিয়া মাদ্রাসায় দুজন শিক্ষক ছাড়া বাকি সবার নিয়োগে ঘুস বাণিজ্য হয়েছে।

উপজেলা যুবদলের আহ্বায়ক মনিরুল ইসলাম বলেন, নাঙ্গলকোটের সর্বেসর্বা ছিলেন শামসুদ্দিন কালু। টেন্ডারবাজি, ঠিকাদারি, সালিশ-দরবার, সরকারের উন্নয়ন বরাদ্দ, জায়গা বেচাকেনা, নিজ দলের কমিটি বাণিজ্য, স্থানীয় সরকার নির্বাচনের মনোনয়ন বাণিজ্যসহ সব সেক্টরের চাঁদা আদায় করতেন তিনি। লোটাস কামাল এখানে এমপি হলেও বাস্তবে এমপির পাওয়ার খাটিয়েছেন শামসুদ্দিন কালু। গত ১৫ বছরে কয়েকশ কোটি টাকার মালিক হয়েছেন তিনি। আমেরিকায় তার একটি বাড়ি রয়েছে। ঢাকায় কয়েকটি বাড়ি রয়েছে বলে শুনেছি।

নাঙ্গলকোট উপজেলা বিএনপির সদস্য সচিব আনোয়ার হোসেন নয়ন বলেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার আগে কালুর তেমন কোনো সম্পত্তি ছিল না। সব উন্নয়ন কাজে তিনি ১০% কমিশন নিতেন। বর্তমানে তিনি আঙুল ফুলে কলাগাছ।

তবে আত্মগোপনে থাকায় অভিযুক্ত সামছুদ্দিন কালুর বক্তব্য পাওয়া যায়নি।- যুগান্তর

twitter sharing button
whatsapp sharing button
print sharing button
copy sharing button