পৃথিবীর একমাত্র মসজিদ যে মসজিদে কখনো নামাজ হয়নি

সাইমুম ইসলাম অপি ।।
প্রকাশ: ১ বছর আগে

এটি এমন একটি মসজিদ যে মসজিদ নির্মাণের পেছনে একটি হৃদয়বিদারক অতীত ইতিহাস লুকিয়ে আছে। কুমিল্লার গোমতী নদীর কোল ঘেষা এই মসজিদটিই খুব সম্ভবত পৃথিবীর ইতিহাসের একমাত্র মসজিদ যেটি ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে মসজিদ হলেও এখানে কখনো আজান হয়নি। পড়েনি কেউ কোনোদিন নামাজ। কারণ এই মসজিদটি একজন নারীর উপার্জিত অর্থে তৈরি হয়েছিল। যে নারী ছিলো পেশাগতভাবে ত্রিপুরা মহারাজা ২য় ধর্ম-মানিক্যের রাজ দরবারের একজন নর্তকী।

প্রায় তিনশো বছর পুরোনো এই মসজিদটি নির্মাণ করা হয়েছিল তৎকালীন ত্রিপুরার রাজা ২য় ধর্ম-মানিক্যের শাসন আমল অর্থাৎ ১৭১৪-১৭৩৪ সালের এ সময়ে। মসজিদের পূর্ব, দক্ষিণ ও পশ্চিম পার্শ্বে কাঠের ছ-মিল এবং উত্তর পার্শ্বে গাছের ঝোপঝাড়, শেকড় ও লতাপাতার কারণে বর্তমানে মসজিদটি আড়াল হয়ে গেছে। ভূ-প্রকৃতির পরিবর্তন, নদী ভাঙ্গন এবং সময়ের সাথে সাথে মসজিদের ভেতরের গম্বুজ এবং দেয়ালগুলোও গাছের শেকড়ের কারনে ফেটে গেছে। স্থানীয় মানুষের নিকট এটি নটির মসজিদ হিসেবে অধিক পরিচিত।

তৎকালীন ত্রিপুরা রাজ্যের রাজা ২য় ধর্ম-মানিক্যের শাসনামলে গোমতীর উত্তর পাড়ে মাঝিগাছা গ্রামে তিন বোন নুরজাহান ও তার ছোট দু’বোন মোগরজান ও ফুলজান বসবাস করতো। যাদের বাবা-মার পরিচয় জানা যায়নি। একদিন কিশোরী নুরজাহানকে সাপে কামড়ালে ভেলায় করে তাকে গোমতী নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হয়। ত্রিপুরা মহারাজার রাজ দরবারের ব্যক্তিরা তাকে দেখে রাজপ্রাসাদে নিয়ে চিকিৎসা করে সুস্থ করে তুলে। পরবর্তীতে রাজদরবারের মেনেকা তাকে নাচ-গান শিখিয়ে রাজ দরবারের সেরা নর্তকীতে পরিণত করেন। মরতে মরতে বেঁচে যাওয়া সুন্দরী নুরজাহানের জীবনে সূচিত হয় একটি নতুন ও ব্যতিক্রম অধ্যায়।

নর্তকী পেশায় রাজা মহারাজাদের দরবারে প্রায় ৩৫ বছর কাটানোর পর মধ্য বয়সে নর্তকী নুরজাহান রাজ দরবার থেকে বিদায় নিয়ে জন্মস্থান মাঝিগাছায় একজন জমিদারের বিধবা স্ত্রী পরিচয়ে বসবাস শুরু করেন। প্রাসাদ ছেড়ে আসার সময় ত্রিপুরার মহারাজা নর্তকী নুরজাহানকে মাঝিগাছায় কয়েক একর জমি ও প্রচুর অর্থ ও স্বর্ণালংকার দান করেন। সে গ্রামের মানুষদের নানা-রকম সাহায্য সহযোগিতা করতেন।

এক সময় অতীত কৃতকর্মের প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য নর্তকী নুরজাহান এক হুজুরের শরণাপন্ন হলে হুজুর নুরজাহানকে নিজ খরচে এলাকায় একটি মসজিদ নির্মাণ করতে বলেন। হুজুরের পরামর্শ মতে নুরজাহান এলাকায় মসজিদ নির্মাণের কাজ শুরু করেন। স্থানীয় গণ্যমান্য লোকজন এ কাজে এগিয়ে আসেন। নুরজাহানের পুরো আর্থিক যোগানে মসজিদ নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়। মসজিদ নির্মাণ শেষে নুরজাহান যে হুজুরের পরামর্শে মসজিদটি নির্মাণ করেছেন সেই হুজুরকে গ্রামবাসীদের সঙ্গে বসে মসজিদে নামাজ পড়ার দিন তারিখ ধার্য করার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। একদিন হুজুর গ্রামবাসীদের সঙ্গে এক সভায় এসে অতি উতসাহী হয়ে নুরজাহানের অতীত জীবন কাহিনী বলে দেন। ঐ দিনই সভায় সিদ্ধান্ত হয় নর্তকী নুরজাহানের অর্থে নির্মিত মসজিদে কেউ নামাজ পড়বে না। এটি নটির মসজিদ। এই মসজিদে নামাজ পড়া জায়েজ না। সেই সিদ্ধান্তের পর থেকেই এ মসজিদে কোনদিন আজান হয়নি। কেউ নামাজ পড়েনি। এ ঘটনার পর নুরজাহান দুঃখে-কষ্টে নিজ গৃহে একাকীত্ব জীবন কাটিয়েছেন বেশ কয়েক বছর।

অনেকের মতে, গ্রামের মানুষের ওই আচরণে আঘাত পেয়ে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে অন্যত্র চলে গেছেন নুরজাহান।

আবার কারো মতে, গ্রামের মানুষের অপবাদ সহ্য করতে না পেরে সে আত্মহত্যা করেছে এবং তার নির্মিত মসজিদের পাশেই তাকে সমাহিত করা হয়েছে।

অপরাধ করতে করতে মানুষ একটা সময় প্রায়শ্চিত্ত করার উপায় খুঁজে। কিন্তু মাত্রাতিরিক্ত অপরাধের কারনে মানুষ সেই সুযোগ থেকেও বঞ্চিত হয়। যার উদাহরণ আমরা নুরজাহানের এই মসজিদ নির্মাণের ঘটনার মধ্য দিয়ে জানতে পারলাম।

কুমিল্লা শহরের প্রাণকেন্দ্র কান্দিরপাড় থেকে চানপুর গোমতী ব্রীজ পার হয়ে নদীর উত্তর তীর ঘেঁষা মাঝিগাছা নন্দীর বাজার সড়কের মুখপথে কালক্রমে ভগ্ন, ঝোপঝাড় আর লতা পাতায় পরিবেষ্টিত জীর্ণ -শীর্ণ এই মসজিদের অবস্থান।

উল্লেখ্য, কুমিল্লাতে অবস্থিত এমন আরও অনেক মসজিদ রয়েছে যেগুলো সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতাব্দীতে নির্মিত হয়েছে। বিশেষভাবে উল্লেখিত কয়েকটি প্রাচীন মসজিদের মধ্যে রয়েছে ১৬৫৯ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত লাকসাম পশ্চিমগাঁয়ের কাজীর মসজিদ, ১৬৮২ খ্রিষ্টাব্দে নির্মিত লালমাই পাহাড়ের চূড়ার আদিনামুড়া মসজিদ, ১৭১৬ খ্রিষ্টাব্দে নির্মিত বুড়িচং উপজেলার ভারেল্লা মসজিদ, ১৭০৬ খ্রিষ্টাব্দে নির্মিত সম্রাট আওরঙ্গজেবের রাজত্বকালে প্রতিষ্ঠিত লাকসামের বাইশগাঁও ইউনিয়নের বড় শরীফপুর মসজিদ এবং ১৭৭৫ খ্রিষ্টাব্দে নির্মিত বরুড়া উপজেলার চিতড্ডা মসজিদ উল্লে­খযোগ্য।