পেয়ারার ভর্তা বিক্রি করেই জীবনের ইতি টানার স্বপ্ন দেখছেন কামাল মিয়া

স্টাফ রিপোর্টার
প্রকাশ: ১ বছর আগে

একটানা ৩৫ বছর ধরে হাটে বাজারে, স্কুলে কলেজে, শহরে গঞ্জে কিংবা যে কোন জনসমাগম এলাকায় ফেরি করে বিভিন্ন ফলের ভর্তা বিক্রি করে সংসারের খরচ নির্বাহ করে আসছেন কামাল মিয়া। গত এক দশক ধরে শুধু পেয়ারার ভর্তাই তিনি বিক্রি করছেন। তিন সন্তানের জনক কামাল মিয়া এই পেয়ারার ভর্তা বিক্রি করেই মেয়েকে বিবাহ দিয়েছেন, দুই ছেলেকে এস এস সি পাস করিয়ে বড় ছেলেকে বিদেশ পাঠিয়েছেন। স্বাবলম্বি কামাল মিয়ার স্বপ্ন, যে পেয়ারার ভর্তা আমার জীবনকে রঙিন করেছে , এই পেয়ারার ভর্তা বিক্রি করেই আমি মরতে চাই।
বলেছিলাম ব্রাহ্মনবাড়িয়া জেলার আশুগঞ্জ উপজেলার তালশহর ইউনিয়নের তালশহর গ্রামের আবদুর রশিদ মিয়ার ছেলে কামাল মিয়ার (৫৫) কথা।পিতা মাতার ৬ মেয়ে ও ৩ ছেলের মধ্যে কামাল মিয়া সবার ছোট।কৃষক বাবা পরের জমি চাষ করে ৯ সন্তান নিয়ে সংসার চালাতেই হিমশিম খেত বলে কোন সন্তানকেই তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পড়াতে পারেননি। তাই কামাল মিয়ারা তিন ভাইয়ের সবাই দিন মজুরের পেশাকেই জীবনের অবলম্বন হিসেবে বেছে নিয়েছেন।

প্রথম প্রথম কামাল মিয়া বাবার সাথে কৃষি কাজ করলেও বয়স যখন কুড়ি পেরলো তখনি পেশা পরিবর্তনের চিন্তা মাথায় এলো তার। ঘর থেকে বড়ই,জলপাই ও তেতুলের আচার বানিয়ে স্থানীয় স্কুলে নিয়ে শুরু করলেন বিক্রি।পরবর্তী জীবনে এই আচার বিক্রিই তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়।
এরপর কখনো আচার,কখনো আইসক্রিম বা কখনো বাচ্চাদের খেলাধুলার সরাঞ্জামাদি বিক্রি করা শুরু করলেন । কিন্তু আচারের মত আর অন্য কিছুতে মুনাফা হয় না তার। তাই আবার শুরু করলেন বিভিন্ন ফলের মৌসুমে ঐ ফল দিয়ে আচার বানিয়ে বিক্রি করা।
বিয়ের পর শ^শুর বাড়ি থেকে আচার বিক্রি না করে ভ্যানগাড়ি চালানোর প্রস্তাব আসলেও বিনয়ের সাথে ফিরিয়ে দেন তিনি। গত ১০ বছর ধরে কুমিল্লা শহরে শুধু পেয়ারার ভর্তাই বিক্রি করছেন। কুমিল্লা নগরীর বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন সময়ে এই পেয়ারার ভর্তা বিক্রি করেই কামাল মিয়া আজ বেশ স্বাবলম্বি।
শনিবার (৩১ ডিসেম্বর,২০২২) কামাল মিয়ার সাথে কথা হয় কুমিল্লা নগরীর ছাতিপট্টি এলাকায়। বেলা সাড়ে ১১টায় এই প্রতিবেদক যখন কামাল মিয়ার সামনে দিয়ে যাচ্ছিলেন তখনি রাঙা হাসি দিয়ে তিনি জানতে চাইলেন, ভর্তা খাইেবেন স্যার। কি মনে করে প্রতিবেদক দাঁড়িয়ে জানতে চাইলেন, আজ কি কাস্টমার নেই। জবাবে কামাল মিয়া জানালেন স্যার, শীতের দিন তো মানুষ এহনও রোডে নামে নাই।তাই অহন পর্যন্ত মাত্র ৬০ টাকা কামাইছি।
কামাল মিয়ার দরদভরা কন্ঠ শুনে প্রতিবেদক ভর্তার অর্ডার দিয়ে তার সাথে কথা বলতে গিয়েই বেরিয়ে এসেছে তার সংগ্রামী জীবনের কত কথা।

কামাল মিয়া প্রতিবেদককে জানিয়েছেন, এই ভর্তা বিক্রি করেই বড় মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। দুই ছেলেকে এস এস সি পাস করিয়েছেন। এর মধ্যে বড় ছেলেকে বিদেশ পাঠিয়েছেন এক বছর হলো। ছোট ছেলেও বিদেশ যাওয়ার চেষ্টা করছে।
ছোট ছেলে বলেছে, সে বিদেশ যেতে পারলে প্রিয় বাবাকে আর ফেরী করে ভর্তা বিক্রি করতে দিবে না। কিন্তু কামাল মিয়া এই কথাতে মোটেও খুশি না। প্রতিবেদককে কামাল মিয়া বলেন, স্যার, যত দিন আমার শরীরে রত (শক্তি) আছে ততদিন আমি কামাই করতে চাই। পোলাগো কইছি, তোরা কামাই কইরা বড় হ। আমি যদ্দিন বাঁচি, শরীর ঠিক থাকলে ভর্তা বেঁইচ্চা যামু।
কামাল মিয়া জানান, তিনি নগরীর শাষনগাছা বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন এলাকায় মেসে থাকেন। প্রতি ১৫ দিন পর পর বাড়ি যান। প্রতিদিন সকাল ঠিক ১০টার সময় তিনি পেয়ারা নিয়ে বের হন। পেয়ারা ভর্তা বানাতে কাসুন্দি, মরিচ ,বিট লবন ও তেতুল ব্যবহার করেন। কখনো ৬টার আগে রুমে যান না। সব সময় বিক্রি এক রকম হয় না উল্লেখ করে তিনি জানান, গড়ে প্রতিদিন ১,০০০ থেকে ১,২০০ টাকা বিক্রি হয়। খরচ গিয়ে মাসে প্রায় ১৫ হাজার টাকার মত থাকে।কিন্তু এখন থাকে ১০ হাজার টাকার মত। ছেলের বিদেশের জন্য কিস্তিতে টাকা নিয়েছে। সেই টাকাও শোধ করেন তিনি।
কামাল মিয়া জানান, গত কয়েক মাস ধরে কামাই অনেক কমে গেছে। মানুষের হাতে টাকা নেই। তাই আগের মত ভর্তাও খায় না। যার কারণে মাঝে মাঝে কিস্তির টাকা তার বকেয়া থেকে যাচ্ছে।
দীর্ঘ ৩৫ বছর ধরে ভর্তা বিক্রি করতে গিয়ে কখনো কোন দু:খজনক ঘটনা ঘটছে কিনা জানতে চাইলে কামাল মিয়া বলেন, ব্যবসা কইরা খাই স্যার , ভিক্ষা করিনা। কিন্তু কিছু কিছু মানুষ আছে আমাগো ভিক্ষুক মনে করে। ধমকাইয়া কথা কয়। এইডাই কষ্ট লাগে মাঝে মাঝে।
কামাল মিয়ার শেষ মিনতি , স্যার , সরকার যদি জিনিস পত্রের দামডা কমাইয়া আরো মেলা দিন গদিতে থাকতো তাইলে মনে হয় মানুষও কিছু কইত না। কিন্ত, স্যার আগে তিন রুডি (রুটি) আর এক ডাইল খাইলে লাগত ২০ টাকা।আর অহন লাগে ৪০ টাকা। কন্ আমরা কিভাবে খামু। সরকারকে বইল্লেন, জিনিসপত্রের দামডা যেন কমায়।