প্রকৃতি সংরক্ষণই পরিবেশ রক্ষা

অধ্যাপক ডাঃ মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ
স্টাফ রিপোর্টার
প্রকাশ: ৫ মাস আগে

বাংলাদেশের বনভূমি, জলাভূমি, বন্যপ্রাণী, নদ-নদী, হাওর, বাউর, খাল-বিল, পাহাড়-পর্বত, সমুদ্র সৈকত খুবই বৈচিত্র্যপূর্ণ। এগুলো রক্ষায় সামগ্রিক জনগোষ্ঠী, বেসরকারী সংস্থা ও সরকারের ইতিবাচক ভূমিকা গ্রহণ জাতীয় আন্তর্জাতিক দায়িত্ব। প্রকৃতি সুরক্ষায় আদালত থেকে নির্দেশনা এসেছে কিন্তু মাঠ পর্যায়ে সঠিক প্রয়োগ হচ্ছে না। মানুষের চাপ ও দূষণের কারণে বনভূমি কমে আসছে। সেন্টমার্টিনের মত সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের মুখে। কক্সবাজারের মত সংরক্ষিত বন দখল করে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন স্টেডিয়াম নির্মাণ করতে চাইছে। এ সফল উন্নয়ন প্রকল্প দেশের সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্যপূর্ণ এলাকায় নির্মাণ করা অবৈধ। বাংলাদেশের প্রকৃতি সুরক্ষার ক্ষেত্রে সমন্বয়ের একটি ঘাটতি রয়েছে। বিজ্ঞানীরা তাঁদের অবস্থান ও ব্যাখ্যা তুলে ধরতে পারতেন। তাঁদের উদ্ভাবন ও মতামতগুলো সহজে সবার কাছে তুলে ধরতে পারতেন। যা সঠিক তা নীতি নির্ধারণে ভূমিকা রাখতে হবে।
বঙ্গোপসাগরে এবং প্রশান্ত মহাসাগরে সামরিক মহড়া হচ্ছে। বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে সমুদ্রপথে উত্তেজনা বাড়ছে। সমুদ্রকেন্দ্রিক যোগাযোগ বেড়ে যাওয়া এবং সমরাস্ত্র প্রদর্শনী বেড়ে গেছে। সমুদ্রের প্রাণী তিমি ও ডলফিনের জন্য এসব কর্মকান্ড বিপদ বাড়িয়ে তুলছে। নদীপথে বড় যানবাহন চলাচল বেড়ে যাওয়া এবং ট্রানজিটের আওতায় জাহাজ চলাচল শুরু হওয়ায় ইরাবতী ও গাঙ্গেয় ডলফিনের জন্য বড় সমস্যা তৈরি হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতেই বাংলাদেশকে উন্নয়নের পথে এগিয়ে যেতে হচ্ছে। আমাদের প্রকৃতি ও প্রাণীজ সম্পদ রক্ষার চ্যালেঞ্জ সামনে এসেছে। প্রকৃতি রক্ষা করে আমরা কিভাবে উন্নয়নের পথে এগোব, তা নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে নব উদ্যোগে। সুন্দরবনের উপর আমাদের যথেষ্ট জ্ঞান তৈরি হয়েছে। আবার প্রভাবশালীদের মাধ্যমে অনেক দ্রুত বন ও জলাভূমি দখল হচ্ছে। পাশাপাশি আন্তসীমান্ত প্রতিবেশগত এলাকাগুলোর ব্যবস্থা নিয়েও আমাদের পরিকল্পনা করা আবশ্যক। বিশে^ জীবাশ্ম জালানীর ব্যবহার নিয়ে বড় সমস্যা তৈরি হচ্ছে। উন্নয়ন ধরে রাখতে হলে বিদ্যুৎ ও জ¦ালানী শক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে। এক্ষেত্রে আন্তসীমান্ত নদীগুলোতে বিদ্যুৎ উৎপাদন নিয়ে আঞ্চলিক সমস্যা রয়েছে। বর্তমান বিশে^ নবায়নযোগ্য জ¦ালানিকে জীবাশ্ম জ¦ালানির বিকল্প বলা হয়। এ উৎসকে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য স্বল্পব্যয়ী ও সহজলভ্য করে তুলতে হবে। অন্যান্য সমস্যার মতো প্লাস্টিক ও বায়ুদূষণের মত আন্তসীমান্ত সমস্যাও সম্মুখে এসে হাজির।
নদী গবেষণায় নতুন প্রক্রিয়া বের করে সকল খাল, নালা ও শাখার খনন কাজ সম্পন্ন করে জলাধার বানানোর চিন্তা মাথায় রাখতে হবে। আমরা মুখে বলি ভূÑউপরিস্থ পানি ব্যবহার করতে কিন্তু বাস্তবে ভূগর্ভের পানি তুলে প্রকৃতির জন্য বিপদ বাড়াচ্ছি। নদীকে দখল, দূষণ ও ধ্বংস হতে রক্ষা করতে হবে। হাতি ও বাঘের জন্য আন্তসীমান্ত করিডোর তৈরি, গবেষণা কারিগরি সহায়তা বাস্তবায়নে অগ্রসর হতে হবে। সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের পরিবেশ, প্রকৃতি ও বন্য প্রাণী রক্ষায় সবাই একসঙ্গে কাজ করা দরকার। শকুন রক্ষায় কিছু কাজ হচ্ছে বলে শকুন বিলুপ্তির হাত থেকে দেশ রক্ষা পেয়েছে। শকুনের জন্য ক্ষতিকর সমস্ত ঔষধ নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে হবে। হাওরগুলো রক্ষার ব্যাপারে সমন্বিতভাবে কয়েকটি বিভাগ একসঙ্গে কাজের নির্দেশনা প্রয়োজন। বৃক্ষসম্পদ জরিপ করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে ও বৃক্ষরাজি সুরক্ষায় যাবতীয় গুরুত্বপূর্ণ পরিবেশবান্ধব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে অনড় ভূমিকা থাকতে হবে।
বাংলাদেশে দুর্গম এলাকাকে বেশী গুরুত্ব দেয়া হয়। কারণ দেশের প্রত্যেকটি মানুষের ভাল করে বেঁচে থাকার অধিকার আছে। যেকোন দূর্যোগ ও জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ ঐ গরিব মানুষেরা। তাঁদের জীবন-জীবিকা রক্ষা ও উন্নতির জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও বনায়নকে গুরুত্ব দেয়া হয়। উপকূলীয় এলাকায় কিছু ম্যানগ্রোভ বন সৃজন করা হয়েছে। এর মাধ্যমে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি থেকে উপকূলবাসীকে রক্ষা করার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। তাদের জন্য অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টিসহ বনায়ন বৃদ্ধি করে উপকূলবাসীকে রক্ষা করতে হবে। ভাসমান জনগোষ্ঠী, জলবায়ু, উদ্বাস্ত বিশেষ করে নারীদের জন্য জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় সহায়তা দেয়া গুরুত্বপূর্ণ। সুন্দরবন ঝড় জলোচ্ছ্বাস থেকে আমাদের মায়ের মত আগলে রাখে, এর সুরক্ষা আমাদের জাতীয় দায়িত্ব। কক্সবাজার দুটি সংরক্ষিত বন আছে একটি টেকনাফ বনভূমি অন্যটি শেখ জামাল জাতীয় উদ্যান। টেকনাফ পেনিনসুলা প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা। রোহিঙ্গারা কক্সবাজারে আশ্রয় নেয়ার পর সেখানকার প্রায় সাড়ে চার হাজার একরের উপর বনভূমি ধ্বংস হয়েছে। তাই সমতলভূমিতেও সামাজিক বনায়ন জরুরী।
আশির দশকে মনে করা হত আমাদের দেশে কোন পরিবেশ সমস্যা নাই। কিন্তু মানুষ নিজেই পরিবেশের জন্য সমস্যা। মানুষ বেঁচে থাকতে ও চাহিদা পূরণ করতে পরিবেশের ক্ষতি করে। এখন পরিবেশের প্রতি সচেতন আচরণকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। এতদিন শুধু গাছকে বনভূমি মনে করা হত। এখন গাছ, মানুষ, বন্য প্রাণী ও পরিবেশ সব মিলিয়ে বনভূমি। ফলে সবাইকে একসঙ্গে থাকার মত পরিবেশ তৈরি করতে হবে। একই সঙ্গে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হবে। ৩০-৩৫ বছর ধরে জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি সামনে এসেছে। এটি শুরুতে বিজ্ঞানীরা বলে আসছিলেন কিন্তু এখন পৃথিবীর সবাই এ নিয়ে কথা বলছেন। জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদান ও চাহিদা মেটানো, যা শিল্পোন্নত দেশগুলো শুরু করেছে। উন্নয়নশীল দেশগুলো একই কাজে উৎসাহী ও প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। ফলে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। ভৌগলিক অবস্থার কারণে বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে এবং একথাও ঠিক দেশটি দ্রুত শিল্পায়নের দিক যাচ্ছে। তাই পড়ে থাকা জমিতে ও বাড়ির আশপাশের জায়গায় বনায়নের কোন বিকল্প নাই।
পরিবেশ সুরক্ষার জন্য সমাজ, গোষ্ঠী ও জাতিসমূহের একসঙ্গে কাজ করতে হবে। কারণ জীববৈচিত্র্য রক্ষার পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তন, দূষণ ও বন্য প্রাণী থেকে রোগ বিস্তারের সমস্যাও বাড়ছে। প্রতিটি মানুষ ব্যক্তিগতভাবে, প্রতিটি সংগঠন তার নিজ এলাকায়, আঞ্চলিকভাবে, নিজ দেশে ও বৈশি^কভাবে কাজ করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে হবে। কোথাও প্রকৃতি ধ্বংসের ঘটনা ঘটলে যার যার অবস্থান থেকে অবস্থান নিতে হবে। প্রকৃতিকে সুরক্ষা না দিয়ে মানুষের উন্নয়ন সম্ভব নয়। নিজেদের উন্নয়ন করতে গিয়ে প্রকৃতিকে ধ্বংস করা হলে সে উন্নয়ন কখনও টেকসই হবে না, হতে পারে না। আইইউসিএন বৈশি^কভবে নতুন কিছু টুল তৈরি করেছে যা দ্বারা জ্ঞান বিনিময়ের সুযোগ বাড়বে। তবে তা সফল হবে সদস্যদের সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে। প্রকৃতি ও বন্যপ্রাণী রক্ষায় অনেক সংগঠনই কাজ করছে। এমনকি রোহিঙ্গা শিবিরেও আইইউসিএন কাজ করছে। সমস্ত সংগঠনগুলি একত্রিত হয়ে সমগ্র বিশে^র গোষ্ঠীগুলির অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানের মাধ্যমে আইইউসিএন প্রকৃতি রক্ষায় ধরীত্রিকে এগিয়ে নিয়ে যাক এ কামনাই পরিবেশবাদীদের। প্রকৃতি ও বন্যপ্রাণী রক্ষা না করলে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা হবে না।

সাবেক অধ্যক্ষ, কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ