ভারাক্রান্ত মন, কচু পাতার পানি ও সাংবাদিকতার চাকুরি!

সময়ের কড়চা-
স্টাফ রিপোর্টার
প্রকাশ: ১ বছর আগে

১.গত কয়েকদিন ধরে শরীরের সাথে মনটিও আমার ভালো যাচ্ছে না। ক্ষণে ক্ষনে ভারাক্রান্ত হয়ে উঠে মন। দেশের বেশ কয়েকটি জেলা থেকে কয়েকজন সহকর্মী জানিয়েছেন তাদের চাকুরি হারিয়ে বেকার জীবন কাটানোর কথা। এর মধ্যে ২৫ ফেব্রুয়ারি শনিবার সকালে খাগড়াছড়ি থেকে আমার পুরোনো এক সহকর্মী ফোন দিয়ে বললেন, এমরান ভাই আপনার অনলাইন নিউজ পোর্টাল কুমিল্লার জমিন এ কাজ করতে চাই। কথাটি বলতে যে উনার বেশ কষ্ট হচ্ছে এবং হৃদয় ভেঙ্গে যাচ্ছে তা প্রায় দুইশ কিলোমিটারের উপর দূরে কুমিল্লায় বসেই আমি বেশ টের পাচ্ছিলাম।
হঠাৎ করে কুমিল্লার অনলাইন নিউজে কেন কাজ করতে চাচ্ছেন তা জানতেই ভেসে এলো নীরব কান্নার শব্দ। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলাম। প্রায় অর্ধ মিনিট চুপ থাকার পর নীরবতা ভেঙ্গে জানালেন, ভাই,দৈনিক দিনকাল সরকার বন্ধ করে দিয়েছে। বেকার হয়ে গেছি। আপনি জানেন আমি কোন রাজনীতি করি না। সাংবাদিকতার জীবনে প্রথম মুক্তকন্ঠে কাজ করেছি। পরবর্তীতে মুক্তকন্ঠ বন্ধ হওয়ার পর অন্য পত্রিকা না পেয়ে দিনকালে জয়েন করেছি। সে থেকে এখন পর্যন্ত দিনকালেই আছি। দিনকাল বেতন না দিলেও নিউজ করে, ছবি তুলে, কিছু ব্যক্তিগত বিজ্ঞাপন ছেপে কষ্ট করে হলেও সংসারটা চালিয়ে নিয়েছি। এলাকার যে কোন সংবাদ সম্মেলন বা সব অনুষ্ঠানেই দাওয়াত পাই, যাই, কখনো সম্মানী পাই কখনো পাই না কিন্তু সারা দিন ঘুরে ফিরে নিউজ করি, ব্যস্ত থাকি, নিজকে সব সময় ব্যস্ত রাখি। দুই ছেলে ও এক মেয়েকে পড়াচ্ছি। বাড়ি থেকে হালকা কিছু আসে। এভাবেই চলে আসছি আল্লাহর রহমতে কোন মতে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, নিজকে সুস্থ রাখার জন্যও ব্যস্ত থেকেছি। কিন্তু পত্রিকা বন্ধ হওয়ার পর একেবারে বেকার। সারাদিন বাসায় থেকে থেকে ভালো লাগে না। স্থানীয় সহকর্মীরা কোন অনুষ্ঠনে দাওয়াত দেয় না। বলে, ভাই আপনারতো পত্রিকা বন্ধ। এলাকায় কয়েকটা অনলাইন থাকলেও মান নেই। তার উপর রয়েছে নিজেদের মধ্যে গ্রুপিং ইত্যাদি। আপনার অনলাইনে কাজ করতে চাই টাকার জন্য না। যাতে সমাজ, পরিবারকে বলতে পারি আমি বেকার না। আমার এক মিডিয়া বন্ধ হলেও আরেকটায় জয়েন করেছি।
২. গত কয়েক বছর আগে একটি স্থানীয় সরকার নির্বাচন কাভার করার জন্য ৭/৮ জন সাংবাদিক নিয়ে কুমিল্লার একটি উপজেলায় গিয়েছিলাম। ঢাকা থেকে প্রকাশিত একটি পত্রিকার এক রাঘব বোয়ালের বাড়িও ঐ উপজেলায়। হঠাৎ করে ঐ রাঘব বোয়াল আমার সাথে থাকা তার পত্রিকার প্রতিনিধিকে ফোনে এমন অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতে লাগল। প্রতিনিধির অপরাধ, ঐ রাঘব বোয়ালের লোকেরা গণতন্ত্রকে গলা টিপে হত্যা করে সিল মারবে এটা তার (প্রতিনিধির) জানা থাকার কথা। সুতরাং সে কেন তাকে না জানিয়ে ঐ নির্বাচনী এলাকায় আসলো। অথচ প্রতিনিধির ঐ নির্বাচনে যাওয়ার বিষয়ে কথিত ঐ রাঘব বোয়ালের অনুমতি কিংবা জানতে চাওয়ার কোন প্রয়োজন নেই। বরং তিনি তার ঐ প্রতিনিধিকে বলতে পারতেন, শোন, তুমি কিন্ত ঐ দিকে যেও না। ওরা কেন্দ্রগুলি নিয়ে নিবে। এ কথা কর্তা ব্যক্তি বললে, সাংবাদিকতার তিন দশকের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, কোন প্রতিনিধিই কোটি টাকার জন্য হলেও ঐ দিকে যাবে না। অথচ, প্রতিনিয়ত জাতিকে জ্ঞান দেওয়া ঐ রাঘব বোয়ালের হুমকিতে চাকুরি হারানোর শংকায় সেদিন আমার ঐ সহকর্মীর বড্ড অসহায় মুখায়বটি আজো আমার মানসপটে ভেসে উঠে। প্রিয় সহকর্মীর ক্রদনরত চেহারাটি দেখে সেদিন মধ্যাহ্নের পূর্বেই নির্বাচনী এলাকা ছেড়ে শহর কুমিল্লায় চলে এসে আপন মনে গেয়ে উঠি এমপি মমতাজ বেগমের সেই বিখ্যাত বিচ্ছেদ গান, বন্ধু বুক ফাইট্টা যায়, ফাইট্টা যায়!
৩. বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎ করেই গণমাধ্যমের মালিক তার পত্রিকা কিংবা টিভি কিংবা অনলাইন নিউজ পোর্টাল বন্ধ করে দেওয়া আমাদের দেশে একটি স্বাভাবিক রেওয়াজে পরিণত হয়ে আসছে। মালিকের ইচ্ছের উপর নির্ভর করে শত শত সাংবাদিক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী বেকারত্ব নামক অভিশাপের বিষ বাষ্পে নীল হয়ে নিঃশেষ হয়ে গেছে। এমন কেস স্ট্যাডি রয়েছে অজস্ত্র।
সরকার মিডিয়া বন্ধ করলে সাংবাদিক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের চাকুরি চলে যায়, মালিক-সম্পাদক বিরাগবাজন হলে চাকুরি চলে যায় এবং মালিক গণমাধ্যম বন্ধ করে দিলে চাকুরি চলে যায়। একেবারেই কচু পাতার পানির মত স্বচ্ছ, সরল সাংবাদিকদের চাকুরি চলে যাওয়া। মাঝে মাঝে মনে হয়, সাংবাদিকতার চাকুরিটি হাওয়া থেকে বাতাস হয়ে ভেসে এসে বজ্রপাতে রূপান্তরিত হয়। বজ্রপাত যেমন এই এলো আবার এই গেলো। ঠিক তেমনি এই আমাদের হত্যভাগ্য পেশাটি।
একেবারেই নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, সরকার মিডিয়া বন্ধ করে দিলে কিংবা মালিক মিডিয়া বন্ধ করলে যে সাংবাদিক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীর চাকুরি চলে যায় তার ক্ষুদ্র একটি অংশই পরবর্তীতে কোন একটি মিডিয়া হাউজ খুঁজে পায়। অধিকাংশই কিছু দিন এদিক সেদিক ঘুরে ছোটখাটো কোন একটি পেশা বেছে নেয় কেউবা আবার শহুরে জীবনে সংসারের ঘানি টানতে না পেরে গ্রামে চলে যায়।
এভাবে আর কত গণমাধ্যম বন্ধ হবে আমাদের দেশের সরকার গুলোর রোশানলে পড়ে। গণমাধ্যমকে বলা হয় একটি রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ। অথচ সব সরকারের আমলেই রাষ্ট্রের এই অন্যতম স্তম্ভটি তাদের অসৎ ইচ্ছা, অনিচ্ছার পুতুলে পরিণত হয়। আমাদের দেশের আওয়ামীলীগ, বিএনপি কিংবা জাতীয় পার্টি যারাই অতীতে ক্ষমতায় ছিল এবং বর্তমানে আছে তারা সবাই চায় গণমাধ্যম তাদের দলীয় মুখপত্রে পরিণত হোক, তাদের পদলেহন করুক, লেজুরবৃত্তি করে দেশের বারোটা বাজলেও তাদের আখের গোছানোর কাজে সক্রিয় ভূমিকা পালন করুক।
অথচ, আমাদের দেশপ্রেমিক নামের কথিত এই রাজনীতিবিদরা যখন বিরোধী দলে থাকে তখন গণমাধ্যমের অবাধ স্বাধীনতার জন্য জিকির করতে করতে মুখে ফেনা তুলে ফেলে। আবার সরকারে এসে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের নামে আইন করে গণমাধ্যম কর্মীদের শৃঙ্খলিত করে রাখতে চায়।
সব সরকারের আমলেই আমাদের দেশে কথিত কিছু মিডিয়া মোড়ল থাকে। তারা বড় বড় পত্রিকা কিংবা টিভির সম্পাদক, মালিক বা টিভি টক-শোর জাঁদরেল আলোচক বা সাংবাদিক। তারা পত্রিকায় বিশেষ প্রবন্ধ, নিবন্ধ লিখে এবং রাতে টিভির টক-শো করে নিজেদের মিডিয়া মোড়ল করে তুলে। তারা প্রতিনিয়ত সরকারকে জ্ঞান দেয়, জনগণকে জ্ঞান দেয়। গণতন্ত্রের জন্য জীবন উৎসর্গ করার জন্য জ্বালাময়ী বক্তব্য দেয়। অথচ, নিজের মিডিয়া হাউজে তিনি গণতন্ত্র দিতে পারেন না। একজন প্রতিনিধির পান থেকে চুন খসলেই দানবীয় আচরণ শুরু করেন। মুহুর্তেই তার রুটি রুজির একমাত্র অবলম্বনটি বাতিল করে দেন। নিজের হীন কায়েমী অসৎ স্বার্থ হাসিল করার জন্য প্রতিনিধিকে স্থানীয় রাজনীতিকদের ক্রীড়ানকে পরিণত করতে চান।
সরকারের হালুয়া রুটির ভাগ ভাটোয়ারা পাওয়ার জন্য সরকারের বিরুদ্ধে কিছু দিন কথা বলেন। পরে যখন সরকার তাকে উচ্ছিষ্ট হালুয়া রুটি দিয়ে দেয় তখন আবার লেজ গুটিয়ে নিজের ব্যক্তিত্বহীনতাকে জাতির সামনে উম্মোচন করে সরকারের চামচামি করা শুরু করে দেন। হালুয়া রুটির জন্য নিজের সম্প্রদায়ের রক্ত খেতেও এই সকল তথা কথিত মিডিয়া মোড়লরা পিছপা হন না। কথায় আছে, কাকের মাংস কাকে খায় না। কিন্তু আমি বলি, কাকের মাংস কাকে না খেলেও আমাদের দেশের কিছু মিডিয়া মোড়ল আছেন তারা তাদের পদ পদবী রক্ষা করার জন্য ও নিজের আখের গোছানোর জন্য শুধু তাদের সম্প্রদায়ের (সাংবাদিকদের) মাংসই খায় না, তাদের মৃত দেহ নিয়েও ছিনিমিনি খেলতে ভুলেন না। তা না হলে আমাদের সাংবাদিক দম্পত্তি সাগর রুনি হত্যা মামলা গত ১১ বছরেও নিস্পত্তি হয় না কেন। ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি রাতে ঢাকার পশ্চিম রাজাবাজারে সাংবাদিক দম্পতি মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক সাগর সরওয়ার এবং এটিএন বাংলার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মেহেরুন রুনি তাদের ভাড়া বাসায় নির্মমভাবে খুন হন। পরদিন ভোরে তাদের ক্ষত-বিক্ষত মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এই হত্যা কান্ডের প্রতিবাদে যখন আমাদের কথিত সাংবাদিক নেতাদের নেতৃত্বে সারাদেশ আন্দোলনে কম্পিত হয়ে উঠল, কেঁপে উঠল সরকারের মসনদ ঠিক তখনি ঐ আন্দোলনের কথিত নায়ককে করা হলো সদাশয় সরকারের উপদেষ্টা। সাংবাদিকদের আন্দোলন উপদেষ্টার চেয়ারের সৌজন্যে ভেসে গেল বুড়িগঙ্গায়। গত প্রায় এক যুগ ধরে মৃত প্রায় বুড়িগঙ্গা দিয়ে অসংখ্য লাশ ভেসে উঠলেও ভেসে উঠেনি প্রিয় সহকর্মী সাগর-রুনির হত্যার প্রতিবাদের আন্দোলন। সাগর-রুনির একমাত্র ছেলে মেঘও আস্তে আস্তে বেড়ে উঠছে আর দেখছে তার বাবা-মার এক সময়ের সহকর্মীরা হালুয়া রুটির জন্য কিভাবে সম্প্রদায়ের রক্তের সাথে বেঈমানি করে।
পৃথিবীর সব পেশাতেই কম বেশী নিশ্চয়তা আছে চাকুরির। কিন্তু উপরের তিনটি কেস স্ট্যাডি পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে একটি রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ নামে পরিচিত গণমাধ্যমে যারা কাজ করেন, যাদেরকে বলা হয় জাতির বিবেক সেই সাংবাদিকদের চাকুরির কোন নিশ্চয়তা নেই, নেই জীবনের নিশ্চয়তাও। যে কেউ সাংবাদিকদের বকতে পারে, মারতে পারে, ডিজিটাল নিরাপত্তা নামের আইন দিয়ে সাংবাদিকদের লাল দালানের ভাত খাওয়াতে পারে কোন সমস্যা নেই। কারণ, অন্য যেকোনো পেশার কিছু হলে সবাই একত্রিত হয়ে প্রতিবাদ করে, প্রয়োজনে প্রতিরোধ করে। আর আমরা সাংবাদিকরা শুধু মাইর খাই। আমাদের মধ্যে কোন ঐক্য নেই। আবার আমাদের দেশের যে কোন পেশার লোকজনের ইচ্ছে হলো সাংবাদিক হওয়ার, ব্যাস, সে সাংবাদিক হয়ে গেলো। হয়তো টাকার জোরে, কিংবা মামু-খালু দিয়ে। সাংবাদিকতার নূন্যতম তার জ্ঞান থাকুক বা না থাকুক, লিখতে পারুক বা না পারুক, শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকুক বা না থাকুক সেই দিকে কারো কোন বিবেচ্য বিষয় নেই। অর্থাৎ গরিবের বউ যেমন সবার বাউজ ঠিক তেমনি সে যেই হোক, যেভাবে পারে একটি কার্ড সংগ্রহ করেই সাংবাদিক বনে যান। হোন্ডা কিংবা গাড়িতে বড় হরফে লিখে দেন সাংবাদিক। গরিবের বউয়ের মতই সবার বাউজ এবং সবাই সাংবাদিক।
জানি না, জীবনে কোন দিন এর ইতিবাচক পরিবর্তন দেখতে পাব কি না। কারো ব্যক্তিগত ইচ্ছা আর অনিচ্ছার উপর আর কত দিন আমাদের চাকুরি নির্ভর করবে বা গণমাধ্যম প্রকাশনা চালু থাকবে, তা জানি না। শুধু এতটুকু জানি, কচু পাতার পানির মতই আমার সাংবাদিকতার চাকুরি ক্ষণস্থায়ী। আর এই ক্ষণস্থায়ী জীবন নিয়েই দেশ তথা জাতির কল্যাণে যত দিন সম্ভব কাজ করে যেতে চাই।

লেখক : সাংবাদিক, সংগঠক, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক লেখক ও টক-শো উপস্থাপক।