শুধু যুদ্ধই করিনি,মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিতও করেছি-মফিজুর রহমান বাবুল

বীরমুক্তিযোদ্ধার অনুগল্প - ৩
শাহাজাদা এমরান ।।
প্রকাশ: ২ সপ্তাহ আগে

যুদ্ধের যাত্রা যখন শুরু :
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু যখন ঢাকার রেইসকোর্সে ঐতিহাসিক ভাষন দেন তখন সেখানে আমিও ছিলাম। ভাষনের পর থেকেই যুদ্ধ যাওয়ার জন্য আমরা মানুষিক ভাবে প্রস্তুতি গ্রহন করা শুরু করি। এরপর কুমিল্লা চলে আসি । ২৫ মার্চ কালো রাতে যখন পাকিস্তান হানাদার বাাহিনী আক্রমন শুরু করল তখন দুই দিন কুমিল্লায় ছিলাম। ২৮ মার্চ দুপুরে যখন কারফিউ শিথিল হলো তখন অনেক কষ্ট করে হানাদার বাহিনী ও রাজাকারদের চোখ ফাঁকি দিয়ে অধ্যক্ষ আফজল খানসহ আমরা কয়েকজন বিবির বাজার সীামান্ত দিয়ে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে প্রবেশ করি। সেখানে গিয়ে আমরা আমাদের নেতাদের সাথে যোগাযোগ করা শুরু করি।
প্রশিক্ষণ যখন শুরু :
আমি আফজল খান ও আমার স্ত্রী রাশেদা রহমানসহ আমরা কাঠালিয়া ক্যাম্পে গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেই। প্রশিক্ষক ছিলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর সদস্যরা। আমাদের প্রশিক্ষন চলাকালীন সময়ে আমাদের ক্যাম্পে প্রায়ই আসতেন কুমিল্লা সদরের সাবেক এমপি, মন্ত্রী কর্নেল আকবর হোসেন বীর প্রতীক। তিনি আমাদের বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে অবগত করতেন। প্রশিক্ষন শেষ করে আমরা ২নং সেক্টরের বিভিন্ন এলাকায় গেরিলা যুদ্ধ শুরু করি।
যুদ্ধের অনুপম গল্প :
প্রশিক্ষণ নিয়ে এক সাথে দুটি কাজ করতে হয়েছে আমাদের। একদিকে গেরিলা যুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্য বিভিন্ন অপারেশনে যেতে হতো। অপর দিকে,যুবকদের যুদ্ধে যাওয়ার প্রস্তুত করার জন্য তাদের সংগঠিত করতে হতো। ভারতের বিলোনিয়ার রাধানগরে আমি,আফজলখানসহ আমরা গড়ে তুলি যুব শিবির। এখানে যুবকদের আমরা প্রশিক্ষণের পাশাপাশি যুদ্ধে যাওয়ার জন্য মানসিক প্রস্তুতি দিতে থাকি। যুদ্ধে আমাদের ২নং সেক্টরের মূল কমান্ডার ছিল খালেদ মোশারফ। পরবর্তী পর্যায়ে কমান্ডার হন ক্যাপ্টেন হায়দার। আমরা ফেনীর মেজর জাফর ইমাম,মেজর আমিন, মেজর এনামের নেতৃত্বে ফেনীর বিলুনিয়া ও পশুরামসহ ও চৌদ্দগ্রামের বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলে যুদ্ধ করি। আমরা ছিলাম গেরিলা যুদ্ধা। আমাদের দলে আফজল খান, জামাল খান,তাাহের,চৌদ্দগ্রামের বীর প্রতীক বাহাউদ্দিন রেজাও ছিল। অন্য যুদ্ধাদের চেয়ে আমাদের রণকৌশল ছিল অনেক ভিন্ন।
নিজের একটি গেরিলা যুদ্ধের কথা বলতে গিয়ে মফিজুর রহমান বাবলু বলেন, যুদ্ধের প্রথম দিকে ক্যাপ্টেন রেজার নেতৃত্বে যুদ্ধে অংশ নিতাম। একদিন চৌদ্দগ্রামের তাহিরপুর এলাকায় যুব শিবিরে বসে আমরা পরবর্তী গেরিলা অপারেশনের বিষয়ে পরামর্শ করতেছি। সম্ভবত রাতে হবে। রাজাকারদের মাধ্যমে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী খবর পেয়ে যায় আমাদের এখানে অবস্থানের। তারা চর্তুদিকে আমাদের ঘিরে ফেলে। ঐ মুহুর্তে আমরা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। কিন্তু যখন বুঝলাম আমরা শত্রুদের দ্বারা বন্দি হতে যাচ্ছি,তখন আমরা তাৎক্ষনিক সিদ্ধান্ত নিলাম। যদি তারা আগে আক্রমন করে তাহলে আমরা সবাই মারা যাব। আর যদি আগেই আমরা আক্রমন করি তাহলে আক্রমন আর পাল্টা
আক্রমনে আমাদের প্রানহানি কম হবে। ঠিক হলেও তাই। তারা সবেমাত্র প্রস্তুতি নিচ্ছে এমন সময় আচমকা আক্রমন করতে করতে শিবির থেকে বের হয়ে গেলাম। তারাও পাল্টা আক্রমন শুরু করে। আমরা আক্রমন শুরু করতে করতে নিরাপদ স্থানে চলে যাই। এ সময় আমাদের দুই সহযোদ্ধা হানাদার বাহিনীর আক্রমনে শহীদ হয়।
পরিচয় :
মফিজুর রহমান বাবুল।পিতা ছিদ্দিকুর রহমান ও মাতা লতিফা খাতুন। ১৯৪৬ সালের ১০ আগস্ট ভারতের পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়িতে জন্মগ্রহন করেন। তাঁর পৈতৃক বাড়ি কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার চিওড়া ইউনিয়নের নবাবপুর গ্রাম।পিতা মাতার ৫ ছেলে ও ৪ মেয়ের মধ্যে তার অবস্থান পঞ্চম। একেবারে হাই স্কুলে পড়ার সময়েই তার রাজনৈতিক স্পুরণ ঘটে। বাংলাদেশ ছাত্রলীগের মাধ্যমে রাজনীতির পাঠশালায় তাঁর যাত্রা শুরু হয়। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় থেকে তিনি সমাজ বিজ্ঞান বিভাগে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করেন। সাবেক মন্ত্রী ও আওয়ামীলীগের বর্ষিয়ান নেতা তোফায়েল আহমেদ যখন ঢাকসুর ভিপি হন সেই কেবিনেটে মফিজুর রহমান বাবলু ছিলেন সমাজ কল্যাণ সম্পাাদক। এ সময় তিনি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে পড়ার সময়ই বৃহত্তর কুমিল্লা জেলা ছাত্রলীগের দুই বার সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৬, ১৯৬৯,১৯৭০ , ১৯৭১,১৯৯০সহ দেশের প্রতিটি গণতান্ত্রিক ও স্বাধীকার আন্দোলনে তিনি রাজপথে থেকে আন্দোলন সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছেন। এ সময় তিনি কারাবরনও করেছেন। ১৯৬৯ সালে তোফায়েল আহমেদ ঢাকার রেইসকোর্সের যে সভায় জাতীর জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বঙ্গবন্ধু উপাধী দেন , সেই সভায় আয়োজকদের অন্যতম সদস্য ছিলেন তিনি। ১৯৬৯ সালের ১৪ ডিসেম্বর বিশিষ্ট ক্রীড়াবিদ ও ক্রীড়া সংগঠক রাশেদা রহমানের সাথে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। তিনি এক ছেলে ও দুই মেয়ের গর্বিত পিতা।