কুমিল্লায়  দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাধিস্থল হওয়ার নেপথ্যে কারণ

স্টাফ রিপোর্টার
প্রকাশ: ৪ মাস আগে

ছায়াঘেরা স্নিগ্ধ নৈসর্গিক পরিবেশ। যেন পাহাড়ের কোলে সাজানো সবুজ গালিচা। কুমিল্লার ময়নামতি ওয়ার সিমেট্রিতে (যুদ্ধসমাধি) এমন স্নিগ্ধ পরিবেশে ঘুমিয়ে আছেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রাণহারানো বিশ্বের ১৩টি দেশের ৭৩৭ জন সৈনিক।

কুমিল্লা-সিলেট আঞ্চলিক মহাসড়কের পশ্চিম পাশে কুমিল্লা সেনানিবাস এলাকার এ যুদ্ধসমাধি ঐতিহাসিক স্থান। প্রতিদিনই বিভিন্ন স্থান থেকে দর্শনার্থীরা দেখতে আসেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের এ স্মারক দেখতে অনেক বিদেশিরও আগমন ঘটে।

কুমিল্লায় যুদ্ধ না হলেও কীভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাধিস্থল নির্মিত হয়েছিল, এমন প্রশ্ন অনেকের মনে ঘুরপাক খায়। ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, বার্মায় (বর্তমান মিয়ানমার) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আহত সৈনিকদের চিকিৎসার জন্য কুমিল্লার ময়নামতিতে স্থাপন করা হাসপাতালে আনা হতো। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যাওয়া সৈনিকদের সমাহিত করতে সমাধিস্থলের প্রয়োজন হয়। কাছেই সেনানিবাস, হাসপাতাল ও সৌন্দর্যের কারণেই ময়নামতি ওয়ার সিমেট্রির ওই স্থানকে সমাধিস্থল হিসেবে বাছাই করা হয়।

মুক্তিযুদ্ধ–গবেষক ও স্বাধীনতাপদক পাওয়া লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) কাজী সাজ্জাদ আলী জহির বীর প্রতীকের বাড়ি কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলার চৌসই গ্রামে। তাঁর কর্মজীবনের বড় একটি অংশ কেটেছে কুমিল্লা সেনানিবাসে। কাজী সাজ্জাদ আলীর বাবা প্রয়াত কাজী আবদুল মুত্তালিব দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের একজন সৈনিক ছিলেন। ময়নামতিতে যুদ্ধসমাধি করার স্থান নির্বাচনে যাঁরা দায়িত্ব পালন করেছেন, তাঁদেরই একজন ছিলেন কাজী আবদুল মুত্তালিব। কাজী সাজ্জাদ আলী জানান, ময়নামতি যুদ্ধসমাধি একাধিকবার ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখিয়েছেন তাঁর বাবা। সমাধিস্থল হিসেবে কোন পরিপ্রেক্ষিতে ওই স্থান নির্বাচন করা হয়, সেটিও তিনি (মুত্তালিব) বলে গেছেন।

সাজ্জাদ আলী বলেন, কুমিল্লা সেনানিবাস থেকে উইলিয়াম স্লিম তাঁর সৈনিকদের প্রস্তুত করেন। তখন প্রতিপক্ষও ফেনীসহ বিভিন্ন এলাকায় বোমাবর্ষণ শুরু করে। একপর্যায়ে উইলিয়াম স্লিম একটা আন্ডারগ্রাউন্ড কমান্ডো ফোর্স গঠন করেন; কুমিল্লা সেনানিবাসে যা এখনো আছে। তখন ময়নামতিতে হাসপাতাল নির্মাণ করা হয়। বার্মায় যুদ্ধে আহত ব্রিটিশসহ মিত্রদেশগুলোর সৈনিকদের বেশির ভাগকে চিকিৎসার জন্য ময়নামতি ও চট্টগ্রামে আনা হতো। কিন্তু কুমিল্লায় কোনো যুদ্ধ হয়নি। তিনি বলেন, আহত জাপানিজ সৈনিকদের মধ্যে যাঁদের চিকিৎসার জন্য আনা হতো, তাঁদের সবাই গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। চিকিৎসাধীন অবস্থায় সৈনিকেরা যখন মারা যান, তখন স্লিম একটা যুদ্ধসমাধি তৈরির সিদ্ধান্ত নেন। সমাধিস্থল নির্বাচনে করা কমিটির সদস্য ছিলেন তাঁর বাবা। তখন তাঁর বাবা স্লিমের সদর দপ্তরে ‘ডিফেন্স ইন্টারপ্রেটার’ হিসেবে কাজ করতেন।

কাজী সাজ্জাদ আলী আরও বলেন, বর্তমান স্থানটিতে প্রথমে ব্রিটিশদের সমাহিত করার কাজ শুরু হয়। জাপানিরা শত্রুপক্ষ হওয়ায় তাঁদের সমাধিস্থলের একটি কোণে জায়গা দেওয়া হয়। যাঁরা মুসলিম ছিলেন, তাঁদের পৃথকভাবে একটি (দক্ষিণ-পশ্চিম) পাশে দাফন করা হয়। কারণ, মুসলিমদের কবর দেওয়ার পদ্ধতি ভিন্ন। সেখানে সমাহিত করা বেশির ভাগই আহত অবস্থায় ময়নামতিতে চিকিৎসার জন্য এসে মারা গিয়েছিলেন।

বর্তমান স্থানটিতে যুদ্ধসমাধি হিসেবে বাছাইয়ের কারণ হিসেবে সাজ্জাদ আলী বলেন, এলাকাটি সেনানিবাস-সংলগ্ন এবং সুন্দর ছিল। ব্রিটিশরা প্রতিটি সমাধিস্থলের জন্য অত্যন্ত সুন্দর জায়গা বাছাই করেছিলেন। ময়নামতির জায়গাটি পাহাড়ি এলাকা, কিন্তু সেই অর্থে পাহাড় নয়। পাহাড়ধস হবে না, বন্যা হবে না, বৃষ্টির পানি আটকাবে না। ছোট ছোট টিলা ও গাছগাছালিতে পরিপূর্ণ ছিল। জায়গাটি এখনো মনোমুগ্ধকর। এসব কারণেই ব্রিটিশরা স্থানটিকে যুদ্ধসমাধি হিসেবে বাছাই করেছিল।

কুমিল্লার ইতিহাস–গবেষক আহসানুল কবীর বলেন, বিশ্বযুদ্ধের সময় কৌশলগত কারণে কুমিল্লা সেনানিবাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে ছিল। যুদ্ধসরঞ্জাম সরবরাহের ক্ষেত্র, বিমানঘাঁটি ও ১৯৪৪ সালে ইম্ফলে স্থানান্তরিত হওয়ার আগে ফোরটিনথ আর্মির (চতুর্দশ সেনাবাহিনী) সদর দপ্তর ছিল কুমিল্লায়। জেনারেলদের গুরুত্বপূর্ণ সভাগুলো এখানে হতো। এ জন্য যুদ্ধাহত সৈনিকদের চিকিৎসার জন্য ময়নামতিতে নির্মিত হাসপাতালে আনা হতো। সেখানে মারা যাওয়া সৈনিকদের সমাহিত করতে ১৯৪৩-৪৪ সালে ময়নামতি ওয়ার সিমেট্রি বানানো হয়।

প্রসঙ্গত, ময়নামতি ওয়ার সিমেট্রিতে ১৯৪১ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত ১৩টি দেশের ৭৩৭ জন সৈনিককে সমাহিত করা হয়। এর মধ্যে মুসলিম ১৭২ জন, বৌদ্ধ ২৪, হিন্দু ২ ও বাকিরা খ্রিষ্টধর্মাবলম্বী। তাঁদের মধ্যে যুক্তরাজ্যের ৩৫৭, কানাডার ১২, অস্ট্রেলিয়ার ১২, নিউজিল্যান্ডের ৪, অবিভক্ত ভারতের ১৭১, রোডেশিয়ার ৩, পূর্ব আফ্রিকার ৫৬, পশ্চিম আফ্রিকার ৮৬; বার্মা, বেলজিয়াম, দক্ষিণ আফ্রিকা ও পোল্যান্ডের ১ জন করে এবং জাপানের ২৪ জন নাগরিকের সমাধি আছে। ১৯৬২ সালে একজন সৈনিকের দেহাবশেষসহ সমাধির মাটি তাঁর স্বজনেরা যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে গিয়েছিলেন। দীর্ঘ ৮১ পর এখন জাপানি ২৪ সৈনিকের দেহাবশেষ নিজ দেশে সরিয়ে নেওয়ার কাজ শুরু হয়েছে। প্রথম আলো