কুমিল্লা আদর্শ সদর উপজেলা প্রকৌশলীর অনিয়ম-দুর্নীতিতে উন্নয়ন কর্মকান্ডে স্থবিরতা

# তিন বছরের বেশি সময় ধরে একই কর্মস্থলে রয়েছেন # কাজ না করেই বিল দেওয়ার অভিযোগ # এডিপির ২০ লাখ টাকার প্রকল্প নিয়ে ধোঁয়াশা # প্রকল্প নির্বাচনে স্বেচ্ছাচারিতা, অনিয়ম
স্টাফ রিপোর্টার
প্রকাশ: ৩ সপ্তাহ আগে

কুমিল্লা আদর্শ সদর উপজেলা প্রকৌশলী মোহাম্মদ সাইফুল ইসলামের বিরুদ্ধে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী একই কর্মস্থলে তিন বছরের বেশি না থাকার বিধান থাকলেও তিনি আছেন বহাল তবিয়তে। একই অফিসের সাবেক হিসাব রক্ষক ও আওয়ামীলীগ নেতা স্বপন কুমার রায়ের যোগসাজসে ইচ্ছামত কাজ ভাগবাটোয়ারা করা, কাজ না করেই বিল উত্তোলনের মত অনেক অভিযোগ প্রকাশ্যে এসেছে। তারা দুই জনই কুমিল্লা সদরের সাবেক এমপি আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার ও সদর উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলাম টুটুলের আশীর্বাদ পুষ্ট এবং এখনো ফ্যাসিবাদের দোসর হিসেবে কাজ করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
গত ১৮ মে রোববার জেলা উন্নয়ন ও সমন্বয় কমিটির সভায়ও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হলে জেলা প্রশাসক ও সভার সভাপতি আমিরুল কায়সার উপস্থিত এলজিইডি কুমিল্লা জেলার নির্বাহী প্রকৌশলীর কাছে এ বিষয়ে জানতে চান। তখন নির্বাহী প্রকৌশলী সভাকে জানান, আমি এখানে নতুন এসেছি। খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিব। তখন জেলা প্রশাসক এ বিষয়ে তদন্ত কমিটি করার নির্দেশ দেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, উপজেলা প্রকৌশলীর কার্যালয়ে এক যুগেরও বেশি সময় ধরে হিসাব রক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন স্বপন কুমার রায়। তিনি বর্তমানে নিষিদ্ধ সংগঠন আওয়ামীলীগের একটি ওয়ার্ড কমিটির সভাপতিও। দীর্ঘ সময় একই কর্মস্থলে চাকরির সুবাদে ডালপালা মেলে তার। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে অবসরে যাওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত নিয়মিত অফিসে যাওয়া আসা রয়েছে স্বপনের। উপজেলা প্রকৌশলী মোহাম্মদ সাইফুল ইসলামের সাথে রয়েছে তার বিশেষ সখ্যতা। দুইজন মিলেই সব প্রকল্পের কাজ ভাগবাটোয়ারা করেন বলে অভিযোগ উঠেছে। স্বপন কুমার রায় অবসরে যাওয়ার পর গত দুই বছরে একে একে তিন জন হিসাব রক্ষক হিসেবে যোগ দেন। তবে কেউই বেশিদিন স্থায়ী হতে পারেননি। স্বপন কুমার রায় অফিসে আধিপত্য ধরে রাখতে ও তার কথামত কাজ না করায় দুই জন হিসাব রক্ষককে ইতিমধ্যে বদলি করা হয়েছে বলে অনুসন্ধানে জানা গেছে।
উপজেলা পরিষদ সূত্রে জানা যায়, ২০২৩-২৪ অর্থ বছরের উপজেলা পরিষদ সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণ খাতে ৭টা স্কিমে মোট ৪০ লক্ষ টাকার একটি ¯েপশাল বরাদ্দ দেওয়া হয়। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের পক্ষে স্বপন কুমার রায় কাজটি করতে গিয়ে ব্যাপক স্বেচ্ছাচারিতা শুরু করেন। ৬ নং স্কীম অর্থাৎ উপজেলা পরিষদ হলরুমের সংস্কার বাবদ ৩ লক্ষ টাকার কাজ না করলেও গত বছরের জুনে স্বপন কুমার রায়কে পুরো বিল দিয়ে দেন উপজেলা প্রকৌশলী। পরে বিষয়টি জানাজানি হলে তিনি গত ১৫ মে ২০২৫ বৃহস্পতিবার থেকে কাজটি শুরু করেন।
এসব বিষয়ে মঙ্গলবার স্বপন কুমার রায় মুঠোফোনে জানান, হলরুমের সংস্কার কাজ নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় ছিলাম তাই দেরি হয়েছে। আমি এখন কাজটি করছি। আশা করছি আজকের (২১ মে) মধ্যে কাজটি শেষ হবে। নিজের অফিস ছিল তাই ভালো ভাবে কাজটি করছি। এছাড়া তার বিরুদ্ধে অন্য সবগুলো অভিযোগ অস্বীকার করেন।
অপরদিকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এডিপির বরাদ্দ হতে বাস্তবায়নের জন্য কালিরবাজার ইউনিয়নে ২০ লক্ষ টাকার একটি প্রকল্প নেয়া হয়েছিলো। ই জিপি সিস্টেমে একজন ঠিকাদার কাজ পাওয়ার পরেও বরাদ্দ স্বল্পতার কথা বলে তা গত বছর বাস্তবায়ন করা হয়নি। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের এডিপির বরাদ্দ থেকে সেই কাজ করার প্রস্তাব দেন প্রকৌশলী মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, প্রকল্পটি বরাদ্দ নেই বলে গত অর্থবছরে বাস্তবায়ন করা যায়নি এ কারনটি সত্যি না। বরং প্রকল্পটির টেন্ডার গত বছরের ২০ আগস্ট অনুমোদন করা হয় যাতে একই টেন্ডারে ঠিকাদার ওয়ার্ক অর্ডার পেয়ে কাজ শুরু করতে পারে। তবে প্রশ্ন উঠেছে, যেখানে এডিপির কাজ ও বিল প্রদান জুনের মধ্যে শেষ করতে হয় ,সেখানে বরাদ্দ না থাকলে কি করে আগস্ট মাসে একই প্রকল্প অনুমোদন হয়। অনুমোদনের পরেও কাজ না হওয়ায় প্রশ্ন উঠেছে ওই প্রকল্পের ২০ লাখ টাকার ভাগ্যে কি ঘটেছিলো। নতুন করে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বরাদ্দে ওই প্রকল্প করার জন্য প্রকৌশলী মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন বলেও উপজেলা সূত্রে জানা গেছে।
এছাড়া ফেব্রুয়ারি মাসে উপজেলা পরিষদের সাধারণ সভায় উপজেলায় ৬টি ইউনিয়নের মোট ৫০টি প্রকল্প ২৪টি প্যাকেজ আকারে উপস্থাপন করেন প্রকৌশলী মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম। পরবর্তিতে প্রকল্পগুলো নিয়ে ব্যাপক আলোচনা সমালোচনার শুরু হয়। মাত্রাতিরিক্ত প্রকল্প ব্যয় এবং বিশেষ ব্যাক্তিদেরকে সুবিধা দিতেই প্রকল্পগুলো নেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ উঠে। পরে প্রকল্পগুলো স্থগিত করে মাঠ পর্যায়ে তদন্তের জন্য পাঠান উপজেলা নির্বাহী অফিসার ফাতেমা তুজ জোহোরা। এতে স্থবির হয়ে পড়েছে উপজেলার উন্নয়ন কর্মকান্ড।
অনুসন্ধ্যানে দেখা গেছে, জগন্নাথপুর ইউনিয়নের বার পাড়া রাবেয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পশ্চিম পাড়া মসজিদ সড়ক আরসিসি করা এবং রিটারিং ওয়াল নির্মাণে দুটি পৃথক প্রকল্পের প্রস্তাব করা হয়েছিল। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পশ্চিম পাড়া মসজিদ সড়কটি মূলত মেম্বার তাজুল ইসলামের বাড়িতে যাওয়ার রাস্তা। ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের পর থেকে মেম্বার তাজুল ইসলাম পলাতক রয়েছেন। তার বিরুদ্ধে মামলাও হয়েছে। এর ফলে অভিযোগ উঠেছে, ২১ সালের সেপ্টেম্বরে প্রকৌশলী মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম যোগদানের পর থেকে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতি করছেন এবং ফ্যাসিবাদের দোসর হিসেবে এখনো কাজ করে যাচ্ছেন।
এসব অভিযোগ অস্বীকার করে প্রকৌশলী মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বলেন, আমার বিরুদ্ধে যদি একটা দুর্নীতির অভিযোগ প্রমান করেতে পারেন, তাহলে আমি চাকরি ছেড়ে দিবো। কাজ না হলেও বিল দেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, অনেক সময় প্রকল্পের মেয়াদের কারনে আগেই বিল উঠিয়ে নিতে হয়। তবে সব কাজ যথাযথ ভাবে হয়েছে। ২০ লাখ টাকা প্রকল্পের বিষয়ে তিনি বলেন, ওই প্রকল্পে কি হয়েছিল তা আমি নথি দেখলে বলতে পারবো। তিন বছরের বেশি একই কর্মস্থলে থাকার প্রসঙ্গে তিনি জানান, এখান থেকে বদলি হওয়ার জন্য আমি চেষ্টা করছি।
সার্বিক বিষয়ে আদর্শ সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার ফাতেমা তুজ জোহোরা বলেন, কাজ না করলেও স্বপন কুমার রায়কে অদৃশ্য কারণে বিল দিয়ে দেওয়া হয়। এটা ঠিক হয়নি। তবে আমি জেনেছি, স্বপন এখন হলরুমের সংস্কার কাজ শুরু করেছেন। এডিপির বরাদ্দকৃত ২০ লাখ টাকার বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাহী অফিসার বলেন, আমি এ মাসের প্রথম দিকে এ বিষয়ে উপজেলা প্রকৌশলীকে নোট দিয়েছি, তিনি নোটের উত্তর এখনো দেননি। প্রকৌশলী এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দিলে আমি বিস্তারিত বলতে পারবো। প্রকল্প স্থগিতের বিষয়ে নির্বাহী অফিসার জানান, সভায় প্রকল্পগুলো উপস্থাপনের পর থেকে এগুলো নিয়ে আমার কাছে বেশ কিছু অভিযোগ আসতে থাকে। তাই যাচাই বাছাই করার জন্য প্রকল্পগুলো স্থগিত রাখা হয়েছে।যাতে সরকারি কাজে কোন অনিয়ম না হয়।
কুমিল্লা জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি আলহাজ¦ শাহ মোহাম্মদ আলমগীর খান বলেন, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার জন্যই দেশের ছাত্র জনতা গত ৫ আগস্ট বুকের তাজা রক্ত বিলিয়ে দিয়ে আওয়ামীলীগ সরকারকে বিতারিত করেছিল। স্বৈরাচার বিদায় হলেও তার দোসররা এখনো বিভিন্ন সেক্টরে বহাল তবিয়বে রয়েছে। আমরা চাই দুর্নীতি মুক্ত সমৃদ্ধশালী একটি সফল বাংলাদেশ। এটা পেতে হলে সর্বাগ্রে দুর্নীতিকে না বলতে হবে। অনিয়ম এবং দুর্নীতি বন্ধ না হলে দেশ কখনো উন্নতি হবে না। আমি মনে করি সরকারের উচিত, যাদের কর্মকাল তিন বছর হয়েছে দ্রুত তাদের বদলি করা। আর আদর্শ সদর উপজেলার
প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে যে অভিযোগ উঠেছে, কুমিল্লা জেলা প্রশাসকসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে অনুরোধ করব,অনতিবিলম্বে তদন্ত কমিটি করা। তদন্তে এই প্রকৌশলী যদি অপরাধী প্রমানিত হয় তাহলে তাকে দৃষ্টান্ত শাস্তি দিতে হবে, যাতে অপর দুর্নীতিবাজরা সতর্ক হয়ে যায়।