দেখার কেউ নেই- উজার হচ্ছে গোমতী চরের মাটি ও বালি

স্টাফ রিপোর্টার
প্রকাশ: ১ বছর আগে

উজার হচ্ছে কুমিল্লার গোমতী নদীর মাটি ও বালি ।যথাযথ তদারকি না থাকায় একদিকে যেমন সরকার হারাচ্ছে মোটা অংকের রাজস্ব অপরদিকে মাটি কাটার ফলে হুমকির মুখে পড়ছে গোমতী বাঁধ, নষ্ট হচ্ছে হাজার হাজার একর কৃষি জমি। গোমতীর বুক ফাটা নিরব কান্না দেখছে না কেউ।
গোমতী নদীর চরের বর্তমান দৃশ্য দেখে দুঃখ প্রকাশ করে কুমিল্লা আদর্শ সদর উপজেলার সামারচর এলাকার বৃদ্ধ হামিদ মিয়া বললেন- ওরা আগে পুরো নদীটাই খেয়েছে। এরপরও ওদের পেট ভরেনি। এখন তাই গিলে খাচ্ছে গোমতীর চর। চরে থাকা সরকারি সম্পত্তির পাশাপাশি কৃষকদের জমির মাটিও ওরা খাবলে খাচ্ছে। ওরা এতোটাই ভয়ংকর যে তাদের নামও মুখে এনে প্রতিবাদ করা যায় না। কারণ তাদের নাম বললেই শুরু হয় নির্যাতন আর হয়রানি।
কুমিল্লা নগরী সংলগ্ন নদী এলাকা সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, লাগামহীনভাবে লোপাট হচ্ছে গোমতী নদীর চরের কৃষি জমির মাটি। পুরো এলাকাটি দেখলে মনে হয়- যেন মাটি কাটার প্রতিযোগীতা চলছে। কোথাও কোথাও চলছে নদী থেকে ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলন। প্রতিটি এলাকাতেই প্রভাবশালীরা নদীর বালু আর চরের মাটি গিলে খাচ্ছেন।
স্থানীয় কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গোমতীর চরের মাটি খেকোদের আগে ‘খাদ্য’ ছিলো শুধুই নদীর বালু। কিন্তু নদী থেকে পর্যাপ্ত বালু উত্তোলন করতে না পারা এবং বর্তমানে নদীর বালুমহলের ইজারা না থাকায় নদীর চর ও নদী সংলগ্ন কৃষি জমিতে ড্রেজার বসিয়ে বালু তোলা হচ্ছে অনেক স্থানে। তবে বর্তমানে বেশিরভাগ স্থানে ভেকু ও কোদাল দিয়ে লোপাট হচ্ছে চরের কৃষি জমির উর্বর মাটি। এতে গোমতী নদীর চর এলাকায় প্রতিদিনই কমছে কৃষি জমির পরিমাণ। আর অবাধে বালু উত্তোলনের ফলে গোমতী নদীর দুই পাশের প্রতিরক্ষা বাঁধও দিন দিন দুর্বল হয়ে পড়েছে। বর্ষার সময় নদীতে জোয়ার আসলেই বড় ধরণের দুর্ঘটনার আশংকা করছেন স্থানীয়রা।
জেলা প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন বোর্ডে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গোমতী নদীর উৎপত্তিস্থল ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যর উদয়পুরে। গোমতী বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে কুমিল্লা আদর্শ সদর উপজেলার কটকবাজার এলাকা দিয়ে। পরে জেলার আদর্শ সদর, বুড়িচং, ব্রাহ্মণপাড়া, দেবিদ্বার, মুরাদনগর, তিতাস ও দাউদকান্দি উপজেলা দিয়ে প্রবাহিত হয়ে মেঘনা নদীতে গিয়ে মিশেছে। বাংলাদেশ অংশে এ নদীর দৈর্ঘ্য প্রায় ৯০ কিলোমিটার । নদীর ডান তীরে ৪১ কিলোমিটার ও বাম তীরে ৩৪ দশমিক ৭৫ কিলোমিটার বন্যা ব্যবস্থাপনা বাঁধ রয়েছে। ২০০৫ সাল থেকে গোমতী নদীর কুমিল্লা আদর্শ সদর উপজেলার অংশে সরকারিভাবে বৈধ ৬টি বালুমহাল ইজারা দেওয়া শুরু হয়। তবে বর্তমানে নদীতে পর্যাপ্ত বালু না থাকায় ২০২১ সাল থেকে ইজারা দেওয়া বন্ধ রাখে জেলা প্রশাসন। বিগত সময়গুলোতে দেখা গেছে ৬টি বালুমহাল ইজারা নিয়ে বালু তোলা হয়েছে অন্তত অর্ধশত স্থানে।
নদীটির কুমিল্লা আদর্শ সদর উপজেলা অংশের সংরাইশ, টিক্কারচর, অরণ্যপুর, ঝাকুনিপাড়া, শালধর পাঁচথুবী, জালুয়াপাড়া, বানাশুয়া, গোলাবাড়িসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গভীর রাত থেকে শুরু হয় চরের মাটি কাটা। থামে ভোর রাতে। ট্রাক্টরে করে গোমতীর চরের বেশির ভাগ মাটি যায় বিভিন্ন ইটভাটায়। ট্রাক্টরের চাকায় নদী পাড়ের পাকা সড়কগুলো এখন চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। অতীতের তুলনায় এ বছর বেড়েছে মাটিকাটা। ক্ষতবিক্ষত গোমতী নদীর চরজুড়ে এখন শুধুই হাহাকার। তবে এই হাহাকার শুনে যারা পদক্ষেপ নেবেন, তাদের দেখা যায় না নদী পাড়ে। চর থেকে মাটি লুটের মহোৎসব চলছে। সেই সাথে ধুলোবালুতে গোমতী পাড়ের বাসিন্দাদের বেঁচে থাকা কষ্টকর হয়ে পড়েছে। শিশুদের রোগবালাই বেড়ে চলেছে। শুধু গোমতীর চরে মাটি কাটাই নয়, অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলনসহ বিভিন্ন স্থানে স্থাপনার নামে নদী দখল হচ্ছে।
কুমিল্লা আদর্শ সদরের দুর্গাপুরের বাসিন্দা আবু ছালেক মিয়া বলেন, ট্রাক্টর আর ড্রাম ট্রাকে মাটি পরিবহনের ধুলাবালুতে আমরার ছেলে-মেয়েগুলো শেষ। রাত হলেই শ^াসকষ্ট আর কাশি বাড়ে ওদের। প্রতি বছর আমাদেরকে এই কষ্ট করতে হয়। এলাকার শিশুদের বায়ুদূষণের কারণে বিভিন্ন রোগবালাই বাড়ছে। এসব বলে কী লাভ? আমাদের কষ্ট আর দুঃখ দেখার কেউ নেই।
আবদুল হান্নান নামে এক ট্রাক্টর চালক জানিয়েছে, গোমতী নদীর মাটির ৯০ শতাংশই যাচ্ছে বিভিন্ন ইটভাটায়। আর বাকিগুলো মানুষ বিভিন্ন ভরাটের কাজে নিচ্ছে। প্রতি ট্রাক্টর মাটির দাম ১২’শ টাকা আর প্রতি ড্রাম ট্রাক মাটির দাম ২২’শ টাকা।
এদিকে, গোমতীর বালু ও মাটি খেকোরা প্রশাসনকেও পাত্তা দিচ্ছে না। সাম্প্রতিক সময়ে নদীর বিভিন্ন অংশে জেলা প্রশাসনের কয়েকজন ম্যাজিস্ট্রেট নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করলেও একদিনের জন্য থামেনি অবৈধভাবে চরের মাটি কাটা। সর্বশেষ গোমতী নদীর বিভিন্ন প্রান্তে অবৈধভাবে মাটি কাটার বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে ৮ লাখ টাকা জরিমানা এবং ৫ জনকে কারাদণ্ড প্রদান করা হয়েছে গত ২৫ ফেব্রুয়ারি। ২৫ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত কুমিল্লা জেলা প্রশাসনের ৭ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান পরিচালিত হয়। এ সময় ১৩টি মামলায় ৮ লাখ টাকা জরিমানার পাশাপাশি তিনজনকে ৫ দিনের ও ২ জনকে ১মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড প্রদান করা হয়েছে। এর আগে গত ২৪ ফেব্রুয়ারি কুমিল্লা আদর্শ সদরের গোমতী পাড়ের এলাকায় পৃথক তিনটি অভিযানে মাটিখেকো চক্রকে তিন লাখ টাকা জরিমানা করেছে ভ্রাম্যমাণ আদালত। এ সময় মাটি পরিবহনের কাজে নিয়োজিত একটি ট্রাক্টর জব্দ করে পুলিশ হেফাজতে দেওয়া হয়।
বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা), কুমিল্লার সাধারণ সম্পাদক আলী আকবর মাসুম বলেন, যেসব অভিযান হচ্ছে- তার প্রায় সবই লোক দেখানো। কারণ মূলহোতারাতো ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাচ্ছেন। যারা ধরা পড়ছেন তারাতো সামান্য শ্রমিক মাত্র। গোমতীর বালু আর মাটি নিয়ন্ত্রণের নেপথ্যে রয়েছে রাজনৈতিক শক্তি। প্রশাসনও জানে কারো এগুলোর নিয়ন্ত্রণ করছে। যতক্ষণ পর্যন্ত প্রশাসন মূলহোতাদের বিরুদ্ধে আইনের সঠিক প্রয়োগ করবে না- ততক্ষণ পর্যন্ত গোমতীর অস্তিত্ব রক্ষা হবে না। পুরো গোমতীর চর এখন মাটি খেকোদের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত।
বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, কুমিল্লার উপ-পরিচালক মো.মিজানুর রহমান বলেন, যেভাবে গোমতী চরের কৃষি জমির মাটি কাটা হচ্ছে- তা বড় বিপর্যয় সৃষ্টি করবে। কুমিল্লার শাক-সবজি উৎপাদনের অন্যতম উৎস গোমতীর চর। এ বছর যেভাবে মাটি কাটা হচ্ছে তাতে করে চর থেকে অন্তত ৭’শ একর ফসলি জমি হারাবে। ।
এসব প্রসঙ্গে কুমিল্লা অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) পঙ্কজ বড়ূয়া জানান, গোমতী নদী চরের মাটিকাটা বন্ধে আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। কাউকে ছাড় দেওয়া হচ্ছে না। আমাদের একাধিক ম্যাজিস্ট্রেট এনিয়ে কাজ করছেন। এসব বালু আর মাটিদস্যুরা যতই প্রভাবশালী হোক না কেন, আমরা তাদের ছাড় দেবো না। আমাদের এই অভিযান অব্যাহত থাকবে।