নিয়ম ভঙ্গ করে কুবি উপাচার্যের গাড়ি বিলাস

শাহাজাদা এমরান ।।
প্রকাশ: ৭ মাস আগে

কৃচ্ছ্রতাসাধনের নামে বৃহস্পতিবার ক্লাস ও শিক্ষার্থীদের পরিবহন বন্ধ রাখলেও একের পর এক নিয়ম ভঙ্গ করে নিজের জন্য অননুমোদিত বিলাসী দামে গাড়ি ক্রয় করেছেন কুমিল্লা বিশ^বিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এএফএম আবদুল মঈন। এমনকি আইনের তোয়াক্কা না করে একই সাথে দু’টি গাড়ি ব্যবহার করছেন তিনি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কুমিল্লা বিশ^বিদ্যালয়ের উপাচার্য ও উপাচার্যের জন্য দু’টি গাড়ি ক্রয়ের জন্য ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১ কোটি ৮৮ লক্ষ টাকা বরাদ্দ রয়েছে। তবে দাম বেড়ে যাওয়ার অজুহাত দেখিয়ে চলতি বছরের ৭ জুন ইউজিসির সচিব বরাবর গাড়ি দুটি ক্রয়ের জন্য ২ কোটি ৯৫ লক্ষ ৫০০ টাকার অনুমোদন ও বরাদ্দ চেয়ে আবেদন করেন ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার মো. আমিরুল হক চৌধুরী। এরপর ১৩ জুন পাবলিক বিশ^বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা বিভাগের পরিচালক মো. জামিনুর স্বাক্ষরিত এক ফিরতি চিঠিতে আগের বরাদ্দকৃত টাকার মধ্যেই দু’টি গাড়ি ক্রয়সহ আরও কিছু শর্ত দিয়ে গাড়ি কিনতে বলা হয়। তবে কুবি উপাচার্য সেসবের তোয়াক্কা না করেই নিজের জন্য বরাদ্দের চেয়ে অধিক মূল্যে একটি গাড়ি ক্রয় করেছেন। যদিও চলতি বছরেই উপাচার্যের পুরাতন গাড়িটির মেরামত বাবদ প্রায় ৫ লাখ টাকা ব্যয় করা হয়েছ। বর্তমানে উপাচার্য নতুন এবং পুরাতন দুটি গাড়িই ব্যবহার করছেন।
বিশ^বিদ্যালয়ের অর্থ দপ্তরসূত্রে জানা গেছে, উপাচার্যের জন্য নতুন ক্রয়কৃত গাড়িটির মূল্য ১ কোটি ৪৬ লাখ ৮৪ হাজার ৫০০ টাকা। যদিও ইউজিসি থেকে এ গাড়ি কেনার জন্য সর্বোচ্চ ৯৪ লক্ষ টাকা ব্যয়ের কথা বলা আছে। একটি গাড়ি ক্রয়েই এ টাকা ব্যয়ের অনুমোদন নেওয়া হয়নি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ থেকে।
কুমিল্লা বিশ^বিদ্যালয়ে শুরু থেকে উপ-উপাচার্যের পদ ছিল না। ২০১৩ সালে আইন সংশোধন করে এ পদ সৃষ্টির পর ২০২১ সালের নভেম্বরে ১ম উপ-উপাচার্য হিসেবে যোগদান করেন অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির। একই বরাদ্দ থেকে তাঁর জন্য গাড়ি কেনার কথা থাকলেও সে গাড়ি এখনো কেনা হয়নি। নিয়োগের দু’বছর পরও বর্তমানে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকল্প পরিচালকের একটি গাড়ি ব্যবহার করছেন।
উপ-উপাচার্যের গাড়ি না থাকার পরও তাঁর জন্য গাড়ি না কেনে উপাচার্যের জন্য নতুন আরেকটি গাড়ি কেনার বিষয়ে উপ-উপাচার্যের মতামত জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘উপাচার্য এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আমি এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাই না।’
এছাড়া নতুন গাড়ি ক্রয়ের ক্ষেত্রে পুরনো গাড়ি অকেজো ঘোষণার করার শর্ত দেওয়া হলেও কুবি উপাচার্য এখনো নতুন ও পুরাতন দুটো গাড়িই ব্যবহার করছেন। চলতি সপ্তাহেই তাঁকে উভয় গাড়িতে চড়তে দেখা গেছে। সরকারি বিধি অনুযায়ী উপাচার্যদের গাড়ি প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে পুরাতন গাড়ির মেয়াদ নূন্যতম ৮ বছর হওয়ার কথা থাকলেও কুবি উপাচার্যের পুরাতন গাড়িটির মেয়াদ ৬ বছর ৮ মাস হয়েছে মাত্র। আবার গত ২ জুলাই প্রকাশিত অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক পরিপত্রে ১০ বছর না হলে পুরনো গাড়ি প্রতিস্থাপন ব্যয় বন্ধ রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এ নির্দেশনাও অনুসরণ করেনি কুবি প্রশাসন।
অন্যদিকে নতুন গাড়ি কেনার বিষয়টি এখনো অগোচরে রয়েছে ইউজিসির। সংস্থাটির অর্থ ও হিসাব বিভাগের পরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মো. রেজাউল করিম হাওলাদার বলেন, উপাচার্য গাড়ি কিনেছেন, বিষয়টি আমরা জানি না। আমাদের নথিতে এ রকম কোনো তথ্য নেই। আমার জানামতে গাড়ি ক্রয়ে বর্তমানে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। নিষেধাজ্ঞার ফলে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে গাড়ির সংকট রয়েছে।
এসব নিয়ে সমালোচনার সৃষ্টি হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়েও। অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. কাজী মোহাম্মদ কামাল উদ্দিন বলেন, উপাচার্য ব্যয় কমানোর কথা বলে বৃহস্পতিবারে শিক্ষার্থীদের বাস বন্ধ করে রেখেছেন। অথচ নিজে দুটি গাড়ি ব্যবহার করছেন। উপাচার্যই যদি নিয়মের ব্যত্যয় করেন, তাহলে অন্য যারা আছেন তাদের অবস্থাটা কী হবে। আমি প্রত্যাশা করি উপাচার্য সকল বিষয়ে সরকার ও ইউজিসির নির্দেশনা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে মেনে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করবেন।
বিষয়টি নিয়ে বিশ^বিদ্যালয়ে সমালোচনা সৃষ্টি হওয়ার পর উপাচার্যপন্থি শিক্ষকরা পুরনো গাড়িটি আগেই অকেজো ঘোষণা করা হয়েছে দাবি করতে থাকেন। তবে তাঁদের এ দাবির পক্ষে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোতে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষও (বিআরটিএ) কিছু জানাতে পারেনি। নিয়মানুযায়ী কোনো গাড়ি অকেজো ঘোষণার জন্য বিআরটিএকে জানাতে হয়। এরপর তাঁদের প্রতিনিধি এসে গাড়ি পরিদর্শন করে প্রযোজ্য ক্ষেত্রে গাড়ি অকেজো ঘোষণা করেন। এ বিষয়ে বিআরটিএ, কুমিল্লার সহকারী পরিচালক মো. আবদুল মান্নানকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, আমাদের কাছে এ ধরনের কোনো চিঠি এসেছে বলে আমার জানা নেই।
জানতে চাইলে ইউজিসির পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ম্যানেজমেন্ট বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ জামিনুর রহমান জানান, পুরাতন গাড়ি অকেজো ঘোষণা করেই নতুন গাড়ি কিনতে হবে। বরাদ্দকৃত অর্থের বেশি খরচ করা যাবে না। অনুমোদন পত্রে শর্তসমূহ উল্লেখ করা হয়েছে। শর্ত না মানা হলে পরবর্তীতে অভিযোগের প্রেক্ষিতে আমরা ব্যবস্থা নেব।
ইউজিসির চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত দায়িত্ব) অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আলমগীর বলেন, গাড়ি ব্যবহারের অনুপযোগী হলে অকেজো ঘোষণার ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট নিয়ম রয়েছে। সেটি অনুসরণ করতে হয়। কেউ যদি বরাদ্দের বেশি অর্থ খরচ করে, তাহলে সেটি অডিট আপত্তিতে (ধরা) পড়ে যাবে।
তবে এসব অনিয়মের বিষয়ে উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এফ এম আবদুল মঈনের বক্তব্য জানার চেষ্টা করেও কথা বলা সম্ভব হয়নি।