‘কবিতা ও গানে হেমন্ত-কে বরণ’ বিষয়ক টক শো অনুষ্ঠিত হয়েছে। সোমবার (১৪ অক্টোবর) রাতে কুমিল্লা আল নূর হসপিটালের সৌজন্যে দৈনিক আমাদের কুমিল্লা ও জনপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল কুমিল্লার জমিনের যৌথ উদ্যোগে এ টক শো অনুষ্ঠিত হয়। সাংবাদিক, সংগঠক ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক লেখক শাহাজাদা এমরানের সঞ্চালনায় টকশো তে অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন চার জন কবি ও লেখক সরদার মোজাম্মেল, হালিম আবদুল্লাহ, রোখসানা ইয়াসমিন মণি ও রানা হাসান।
এসময় টকশো তে হেমন্ত বরণ নিয়ে গান ও কবিতা আড্ডার পাশাপাশি হেমন্ত ঋতুকে নিয়ে ও বাংলা সাহিত্য নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা উঠে এসেছে।
আলোচনার এক পর্যায়ে সরদার মোজাম্মেল বলেন, বাংলাদেশে আমরা ৬টি ঋতু পাই৷ অন্যান্য দেশে হেমন্ত ঋতুর তেমন দেখা পাওয়া যায় না। বঙ্গপোসাগরের কারণে এটা হয়ে থাকে বলে ধারণা করা হয়। কার্তৃক মাস হলো অভাবের মাস, আর অগ্রহায়ণে ধান কেটে ঘরে তুলে। তাই হেমন্ত ঋতুটিকে আমরা ফসলের ঋতুও বলতে পারি৷ এই ঋতুতে নবান্নের উৎসব শুরু হয়ে যায়। এতে করে, প্রতিবেশীদের প্রতি আন্তরিকতা তৈরী হয়।
এছাড়াও, বাউলগান, জারিগানের মতো উৎসবও এই ঋতুতে হয়ে থাকে। তাই হেমন্ত ঋতুটি আমাদেরকে অন্য ঋতু থেকে আলাদা করে। এই ঋতুটি আবার নাতিশীতোষ্ণ ঋতুও। এই সময়ে না শীত, না গরম। এই ঋতুতে কৃষকের চোখে মিট মিট করে আশার আলো জ্বলে। জীবনানন্দ দাশ হচ্ছেন হেমন্তের কবি। তার কবিতাগুলোর বেশীরভাগই হেমন্তকে ঘিরে লেখা। এখন আমাদের আবহাওয়া ও জলবায়ুর পরিবর্তন হয়েছে। আগে আমরা সব মিলিয়ে প্রায় ৬ মাস শীতের পরিবেশ পেলেও এখন আমরা ২ মাস পাই। আর এই কারণে, হেমন্তের জৌলুস হারানো শুরু করেছে।
এখন সারাবছর ধরেই ফসল উৎপাদন হয়। তাই হেমন্তের সেই আমেজ আর আমরা পাই না। আমরা ইট পাথরের দেয়ালে বন্দী হয়ে গিয়েছি। আমরা যারা লেখা লেখি করি, আমরা হেমন্তকে সাহিত্যের মাধ্যমে বাঁচিয়ে রাখতে পারি। পাঠক কি চায়, আমাকে সেটা দিতে হবে। আমাদের সময়কার লেখকেরা সময়কে ধরতে পারে না, তাই তারা পাঠক হারায়৷ আবার এখন পাঠক সংখ্যাও অনেক কমে গিয়েছে। তবে, এটার কারণ হিসেবে আমি প্রযুক্তিকে দায়ী করবো। প্রযুক্তি ব্যবহার কমিয়ে আনতে হবে আমাদেরকে।
হালিম আবদুল্লাহ বলেন, আমরা এখন কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। মানুষের পাঠাভ্যাস কমে যাচ্ছে। সারাবাংলাদেশের মতো প্রান্তিক পর্যায়েও এর প্রভাব কমে যাচ্ছে। তবে, প্রকাশনা শিল্প কখনো শেষ হবে না। মানুষ পড়বেই। কুমিল্লাও একসময় শিল্প সাহিত্য ও সংস্কৃতির নগরী ছিলো৷ কুমিল্লা এখনো সাহিত্যের স্বর্ণ্যযুগ পার করছে বলে আমি মনে করি৷ বিদেশী সাহিত্যের সাথে আমাদের বাঙ্গালী সাহিত্য লড়াই করে টিকে আছে বলে আমি মনে করি। তবে, কালের পরিবর্তনের সাথে সাথে সাহিত্যের চর্চার ধরণও পালটে যায়। আগে সাংগঠনিক চর্চা অনেক বেশী ছিলো যা এখন দেখা যায় না। যারা লেখক তারাই মূলত পাঠক হয়৷ লেখক যদি না পড়ে, তাহলে তার লেখনী সুন্দর হবে না৷ বর্তমানে লেখতে গেলে কোনো প্রস্তুতি নেয়া হয় না। তবে আমি আশাবাদী এই ঘোর কেটে যাবে। আর, লেখক মানেই ঢাকা, আবার প্রকাশনা মানেই ঢাকা। আমাদেরকে এই দিক থেকে বের হয়ে আসতে হবে।
রোখসানা ইয়াসমিন মণি, হেমন্তকে আমরা বরণ করে নিতে প্রস্তুত রয়েছি। আমি মূলত লেখালেখি করেছি বেশীদিন হয় নি। আমি লেখক হবো তা আমি কল্পনাও করতে পারি নি। লেখকদের লেখনী আমাকে ভাবাতো। তারা কিভাবে লিখতো তা নিয়ে ভাবতাম। আমার শৈশবের ডাকাতিয়া নদী আমার জীবনে অনেক বেশী প্রভাব ফেলেছিলো। তাছাড়া, আমার বাবা নিজেও নাটক লিখতেন, থিয়েটার করতেন। আমার বাবার কাছ থেকেও আমি অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম। তাছাড়া, জ্যোৎস্না রাতে দিঘীতে নৌকা নিয়ে আমরা ভাইবোনেরা মিলে ছড়তাম।
এই বিষয়গুলো আমার কল্পনায় আসতো, তখন থেকেই লেখালেখি শুরু করেছিলাম। লেখালেখি করার সময় বাস্তবতাকে উপলব্ধি করে লিখতাম। গাছকে নিজের বন্ধু বানাতাম, গাছের সাথে কথা বলতাম। তখন সেই গাছকে নিয়ে কবিতা লিখতাম। চাঁদকে নিয়ে কবিত লিখতাম, নদী নিয়ে লিখতাম। আমাদের একেকজনের চিন্তাভাবনা একেক রকম। সেই চিন্তাভাবনার দোলাছাল থেকেই আমার লেখালিখি শুরু।
রানা হাসান বলেন, ছোট বেলায় গ্রামে থাকতে জমিতে ধান বড় হওয়ার পর আমরা ধান বড় হওয়ার অপেক্ষা করতাম। হেমন্ত ঋতুর অপেক্ষা করতাম৷ কিন্তু, শহরে চলে আসার পর আর হেমন্তের অপেক্ষা করা হয় না। এখন লেখক বা কবি হিসেবে সেই দিনগুলো এখন আমার কল্পনার দোল খেলে। শহরের ছোঁয়ায় আমরা সেগুলো হারিয়ে ফেলেছি। এখন কবিতা লিখতে বসলেই শহরের ইট পাথরের দেয়াল ও জঞ্জালগুলো মাথায় চলে আসে। আমরা ইট পাথরের দেয়াল নয় আমরা গ্রামের মুক্ত বাতাসে দোল খেলতে চাই।
আবার, আমাদের চিন্তা শক্তিকে রঙ তুলিতে তোলা এটাও একটি দারুণ বিষয়। তবে, আমাদের এই চর্চাগুলো অনেকটা পিছিয়ে গিয়েছে। আগে এটার কদর ছিলো, মানুষ এটার প্রশংসা করতো৷ কিন্তু, এখন চিত্রাঙ্কন শুধুমাত্র প্রতিযোগীতা আর পুরষ্কারের মাধ্যমেই সীমাবদ্ধ। আমাদেরকে এই ধারণাগুলো থেকে বের হতে হবে। প্রযুক্তি ব্যবহারের পরিমিত ব্যবহার করতে হবে৷ কুমিল্লায় এই চর্চাটা হচ্ছে, তবে সেটাকে আরো বাড়াতে হবে।