৪৫ বছরের পথ পরিক্রমায় বিএনপির অর্জন কী?

সময়ের কলাম....
মারুফ মল্লিক ।।
প্রকাশ: ৮ মাস আগে

নানা চড়াই-উতরাই পার করে প্রতিষ্ঠার ৪৫ বছরে পা দিল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি। ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর বিএনপি গঠন করেন দেশের ইতিহাসের এক কঠিন সময়ে সেনাবাহিনী থেকে রাজনীতিতে আসা সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। ওই সময় বিশ্বের অনেক দেশেই সামরিক বাহিনীর প্রধানেরা রাজনীতির মাঠে পা রেখেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সুবিধা করতে পারেননি। ওই সব শাসকের পতনের পর তাঁদের শাসনব্যবস্থারও অবসান ঘটে।

এদিক থেকে জিয়াউর রহমান ব্যতিক্রম। তিনি একটি রাজনৈতিক দল গঠন করলেন। প্রবল জনপ্রিয় আওয়ামী লীগের সমপর্যায়ে নিয়ে এলেন দলটিকে এবং এই কাজ করলেন তিনি অতি অল্প সময়ে। আওয়ামী লীগের দীর্ঘ রাজনৈতিক ইতিহাস ও ঐতিহ্য আছে। এই দলের সংগঠক সবারই বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ছিল। এর বিপরীতে জিয়াউর রহমান কিছু মধ্যবয়সী মধ্যম সারির রাজনীতিবিদ, কিছু পেশাজীবী ও কিছু তরুণকে নিয়ে গড়ে তুললেন বিএনপি। বলাবাহুল্য, এই দলে নানা মত ও পথের রাজনীতিবিদের সম্মিলন ঘটেছিল। ফলে অনেকেই সন্দিহান ছিলেন শেষ পর্যন্ত বিএনপি টিকবে কি না।

বিএনপিকে অনেকেই ঠাট্টা করে রাজনৈতিক ক্লাব বলতেন। কিন্তু এই রাজনৈতিক দলই শেষ পর্যন্ত অন্যতম শক্তিশালী দলে পরিণত হয়েছে। এই ৪৫ বছরের পরিক্রমায় বেশ কয়েকবার দলটির হারিয়ে যাওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছিল। ভাঙনের মুখোমুখি হয়েছে একাধিকবার। বিগত প্রায় ১৬ বছর দলটি ভয়াবহ দমন-নিপীড়নের শিকার হয়েছে। বিএনপির লাখ লাখ নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে নানাবিধ মামলা চলমান। এমন কোনো দিন নেই, যেখানে বিএনপির নেতা-কর্মীদের আদালতে হাজিরা থাকে না। দলটির অনেক নেতা-কর্মী গুমের শিকার হয়েছেন। এত কিছুর পরও দলটি এখনো প্রবলভাবে রাজনীতিতে টিকে আছে। এটা দলটির রাজনৈতিক প্রতিপক্ষও স্বীকার করতে বাধ্য হবে।

প্রথাগত রাজনীতির মাঠে তৈরি না হওয়ার পরও বিএনপির পরিপক্ব দলের মতোই নিজের অবস্থান শক্তিশালী করেছে। এ ক্ষেত্রে দুটি বিষয়কে আলোচনার ভরকেন্দ্র হিসাব করে এগোনো যেতে পারে। এ দুটি দিক হচ্ছে প্রায়োগিক ও আদর্শিক ভাবনা। প্রায়োগিক দিকটি হচ্ছে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পর বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে যাত্রা শুরু করে। আমরা একটি স্বাধীন ভূখণ্ড, মানচিত্র ও একটি পতাকা পেয়েছিলাম। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, কার্যকর রাষ্ট্র বলতে যা বোঝায়, তা আমরা অর্জন করতে পারিনি। স্বাধীনতার পরপরই একটি কার্যকর শাসনব্যবস্থা গড়ে তুলতে তৎকালীন রাজনৈতিক দলগুলো ব্যর্থ হয়েছিল। দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও হানাহানি ছড়িয়ে পড়েছিল চতুর্দিকে।

এই রকম একটি অবস্থার বিপরীতে দাঁড়িয়ে বিএনপি যাত্রা শুরু করে। মূলত বিএনপির আমলেই একটি কার্যকর রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ যাত্রা শুরু করে। দক্ষ প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়। আমলাতন্ত্রকে মেধার ভিত্তিতে ঢেলে সাজানো শুরু হয়। সামরিক বাহিনী পুনর্বিন্যাস করে এর ব্যাপ্তি বাড়ানো হয়। বিএনপির আমলে নারী পুলিশ নিয়োগ করা হয়। আনসার ভিডিপি গড়ে তোলা হয় নতুন করে। প্রশাসনিক সংস্কারের পাশাপাশি অর্থনৈতিক উন্নয়নের বিষয়টিও উল্লেখযোগ্য।

সারা দেশে কৃষির উন্নয়নে ব্যাপক কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছিল বিএনপির প্রথম আমলে। খাল খনন ও সেচব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন করা হয়। খাল খনন, কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচির মতো বিভিন্ন কর্মসূচিতে ব্যাপকভাবে সাধারণ মানুষের সম্পৃক্ততা সৃষ্টি করা হয়। ব্রিটিশ ও পাকিস্তানিদের দ্বারা শাসিত ও শোষিত মানুষ এই প্রথম রাষ্ট্রকে কাছ থেকে নিজের মতো করে দেখতে পেল এবং এর সুফল ভোগ করতে শুরু করল। বিএনপির হাত ধরে অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক সংস্কারের কারণে নতুন নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হতে শুরু করে। কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির পাশাপাশি বিএনপির আমলে প্রবাসী আয় ও পোশাক রপ্তানির আয় থেকে নতুন এক মধ্যবিত্ত শহুরে নাগরিক শ্রেণির বিকাশ ঘটতে শুরু করে এবং রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতিতে এই নয়া মধ্যবিত্ত শ্রেণির নেতৃত্বের উত্থান লক্ষ করা যায়।

এই নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ নেহাতই আদর্শবিহীন ফাঁপা কোনো সমাজে হয়নি; বরং বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের মতো একটি উদার ও বহুপক্ষীয় বহুদলীয় রাজনীতির ওপর নির্ভর করে নতুন রাজনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থার বিকাশ ঘটতে শুরু করে। সমালোচকেরা বলে থাকেন, বিএনপির কোনো আদর্শ নেই। প্রতিপক্ষ তো সমালোচনা করবেই। তবে বিএনপির ব্যর্থতা হচ্ছে, নিজেদের আদর্শ ও দর্শনকে সঠিকভাবে তুলে ধরতে না পারা; বরং কিছুটা মনে হয় বিএনপি এ বিষয়গুলো নিয়ে খুব বেশি ভাবনাচিন্তা করে না বা বিএনপি কীভাবে গড়ে উঠল, জনপ্রিয়তার ভিত্তি কী, এসব নিয়ে খুব গভীরভাবে অনুসন্ধান করার প্রয়োজন অনুভব করেনি।

বিএনপি মূলত একটি উদার, বহুপক্ষীয় সামাজিক গণতন্ত্রী মধ্য বামধারার রাজনৈতিক দল হিসেবে যাত্রা শুরু করেছিল। কিন্তু এখন বিএনপিকে সামাজিক গণতন্ত্রী বা মধ্য বাম ধারার দল বলে উল্লেখ করলে আওয়ামী লীগ ও ইসলামপন্থীদের কঠোর সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয়। মূলত বাঙালি জাতীয়তাবাদের মতো একরৈখিক সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের দল হয়েও আওয়ামী লীগ নিজেদের উদার ও মধ্য বামধারার বলে পরিচয় দিতে পছন্দ করে। কিন্তু বাঙালি জাতীয়তাবাদের মতো জাতিবাদী চিন্তার ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে উদারপন্থী রাজনৈতিক দল হওয়া তাত্ত্বিক ও বাস্তবিকভাবেই সম্ভব নয়। কারণ, এই চিন্তা রাষ্ট্রের নাগরিকদের মধ্যে বাঙালি ও অবাঙালির বিভাজন তৈরি করে। বিপরীতে ইসলামপন্থীরাও বিএনপিকে ইসলামি ঘরানার দল হিসেবে মনে করে। বিএনপি সংবিধানে ধর্মীয় উপাদান যুক্ত করেছিল বটে, কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে, বিএনপির হাত ধরেই দেশে নারী ফুটবলের যাত্রা শুরু হয়।

আওয়ামী লীগ বিএনপিকে উদার ও মধ্য বামধারার হিসেবে মানতে চায় না রাজনৈতিক চতুরতার জায়গা থেকে। কারণ, দেশের রাজনীতিতে ধর্মকেও ব্যবহার করে আবার বহির্বিশ্বে নিজেদের উদার মধ্য বাম বলে পরিচয় দিয়ে সুবিধাও নিতে চায়। বিপরীতে ইসলামপন্থীরা বিদ্বেষ ও অজ্ঞতাপ্রসূত জায়গা থেকে বিএনপিকে মধ্য বাম হিসেবে খারিজ করে দেয়।

ভ্রান্তি দূর করার উদ্দেশ্যে বলে রাখা ভালো, মধ্য বামেরা প্রথাগত ধারার বামপন্থী বিপ্লবী দল নয়। এরা পুরোপুরি মার্ক্সবাদী, লেনিনবাদী বা মাওবাদী দলও নয়। তবে সম্পদের বণ্টনের প্রশ্নে মার্ক্সবাদের প্রভাব লক্ষণীয়। ১৮৪৮ ফ্রান্সে ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের মাধ্যমে দ্বিতীয় রিপাবলিক গঠনের মধ্য দিয়ে ইউরোপ উদার সামাজিক গণতন্ত্রীপন্থী বা মধ্য বামধারার রাজনীতির বিকাশ ঘটতে শুরু করে। ওই সময় ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বিপ্লবের মাধ্যমে রাজতন্ত্রের উচ্ছেদ করা হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর সশস্ত্র বিপ্লবের পথে না গিয়ে মধ্য বামেরা মনে করত, নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে ইনসাফের ভিত্তিতে বিপ্লবী রাষ্ট্র কায়েম করা সম্ভব। এই বিপ্লব হবে সংস্কারের মাধ্যমে পরিবর্তন আনয়ন করে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক বিপ্লব। এরা ধর্মকে পুরোপুরি বাতিল না করে ধর্মীয় মূল্যবোধের ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনাকে গুরুত্ব দেয়।

মধ্য বামেরা পুঁজিকে শত্রুজ্ঞান না করে বরং পুঁজির রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত বিকাশের বাজারের ক্ষমতাকে সীমিত করে রাখে। এরা সুষ্ঠু ও সাম্যের ভিত্তিতে নৈতিকতার মাধ্যমে অর্থনীতিকে পরিচালনা করে। মধ্য বাম রাজনীতির মূল বিষয় হচ্ছে, সম্পদের সুষম বণ্টন, গণতান্ত্রিক অর্থনৈতিক সুশাসন ও নাগরিকের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। মধ্য বাম বা সামাজিক গণতন্ত্রী ধারার রাজনীতি হচ্ছে বাম ও ডান উভয় পন্থা থেকে সরে আসা মধ্যপন্থার একটি আদর্শ। যারা জাতিবাদী শ্রেষ্ঠত্বকে গ্রহণ না করে একধরনের সর্বজনবাদী রাজনীতির সূচনা করে।

বিএনপির অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কর্মসূচি ও দর্শনের মূল ভিত্তি ছিল পশ্চিম ইউরোপের মধ্য বামধারার উদার সমাজতন্ত্রী রাজনীতি। পূর্বের বাকশালের একদলীয় শাসনব্যবস্থার পরিবর্তে বিএনপি বহুদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে কেন্দ্রীভূত কাঠামোকে বাদ দিয়ে বেসরকারি খাতের বিকাশকে উৎসাহিত করেছিল। তবে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছিল। চুরি, দুর্নীতিতে, পাচারকে রোধ করে নৈতিক অর্থনীতি কায়েম করার চেষ্টা করেছিল। শাসনব্যবস্থাকে গ্রাম সরকারের মাধ্যমে প্রান্তিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা ছিল। বিএনপির তিনবারের শাসনামলে সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর পরিধি বৃদ্ধি করা হয়েছিল কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি, বিনা মূল্যে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা, অর্থের বিনিময়ে শিক্ষা, অবৈতনিক নারী শিক্ষাসহ নানাবিধ কর্মসূচির মাধ্যমে। নারীর ক্ষমতায়নে বিএনপির উদ্যোগ প্রশংসনীয় ছিল নিঃসন্দেহে।

বিএনপির সময় গৃহীত বিভিন্ন উদ্যোগ বাস্তবায়নে গুণগত মান হয়তোবা খুব উচ্চমানের ছিল না। দুর্নীতিও হয়েছে বিস্তর। প্রতিপক্ষকে নির্মমভাবে দমনের অভিযোগ বিএনপির বিরুদ্ধেও বিরোধীরা করে থাকেন। কিন্তু একটি উদার বহুপক্ষীয় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিকল্পনার সূচনাকারী হিসেবে কৃতিত্ব বিএনপি দাবি করতেই পারে। বিএনপি দুর্দান্ত কিছু পরিকল্পনা নিয়ে রাজনীতিতে আবির্ভূত হয়েছিল। এসব কারণে বিএনপিও দ্রুতই জনমানসে স্থান করে নেয়।

বিএনপির রাজনীতিতে মুক্তিযুদ্ধের সাম্য, সুষম বণ্টনের স্বপ্ন ও চেতনা প্রবলভাবে পরিলক্ষিত হয়। তবে এটা ঠিক ৪৫ বছরের পরিক্রমায় বিএনপি সেই আদর্শ ও চেতনা থেকে বিচ্যুত হয়েছে। অনেক সময় সমঝোতাও করেছে ভিন্নমতাবলম্বীদের সঙ্গে। নিজস্ব অবস্থান অনেক সময়ই ধরে রাখতে পারেনি। কিন্তু পরিশেষে বিএনপি মুক্তিযোদ্ধাদের দল। যাঁরা ১৯৭১ সালে সবকিছু তুচ্ছজ্ঞান করে স্বাধীনতার জন্য যাঁরা জীবন সঁপে দিয়েছিলেন, তাঁরাই পরবর্তী সময়ে এক জোট হয়ে গঠন করেন বিএনপি। আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের অন্যতম রাজনৈতিক ফসলও এই বিএনপি।

ড. মারুফ মল্লিক লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক