ডিসি-এসপিকে স্যার বলতে হবে কেন ? – শাহাজাদা এমরান

সময়ের কড়চা
স্টাফ রিপোর্টার
প্রকাশ: ১ বছর আগে

গত ২২ মার্চ ২০২৩ সন্ধ্যায় একটি স্কুলের বিষয়ে রংপুর জেলা প্রশাসক ড. চিত্রলেখা নাজনীন এর সাথে দেখা করতে যান বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একাউন্টিং এ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক উমর ফারুক। এসময় জেলা প্রশাসক ড. চিত্রলেখা নাজনীনকে ‘স্যার’ সম্বোধন না করায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানান ড. চিত্রলেখা নাজনীন এবং চাপ প্রয়োগ করেন। এর প্রতিবাদে তিনি ডিসি ক্যাম্পাসে প্রতিবাদী কর্মসূচি গ্রহন করেন। এরপর বিষয়টি রংপুরের সীমানা অতিক্রম করে সারা দেশময় ছড়িয়ে যায় বর্তমানে যা বিশে^র গণমাধ্যমেও আলোচিত।

আমাদের সংবিধানে পরিস্কার ভাষায় বলা আছে, ‘সরকারি কর্মকর্তারা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসেবে অভিহিত হইবেন এবং সংবিধানের ২১ অনুচ্ছেদে সকল সময়ে জনগণের সেবা করিবার চেষ্টা করা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির কর্তব্য হইবে বলিয়া ঘোষণা করা হইয়াছে।’

কিন্তু দু:খজনক হলেও সত্য যে, হালে আমাদের দেশের আমলারা নিজেদের প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী নয় তারা নিজেদের রাজা ভাবতে শুরু করেছে। তারা ভুলেই গিয়েছে, জনগনের কষ্টার্জিত ট্যাক্সের টাকার একটি অংশ তাদের পড়াশুনায় ব্যয় হয়েছে। বর্তমানে তারা চাকুরি করছে। এখন আবার সেই জনগনের ট্যাক্সের টাকাই তাদের বেতন ভাতা চলছে। সংবিধানের ২১ অনুচ্ছেদ মতে, জনগনের সেবা করা তাদের সাংবিধানিক কর্তব্য, দয়ার উপর নির্ভরশীল নয়। কিন্তু তারা যখনি চেয়ারে বসেন তখনি নিজেদের রাজা ভাবতে শুরু করে আর দেশের জনগনকে প্রজা মনে করে যা ইচ্ছে তা করতে নূন্যতম পিছপা হচ্ছে না। ক্ষেত্র বিশেষ সভ্যতা আর ভব্যতাও ভুলে যায় তারা।
প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা নিজেদের কর্মচারি বা জনগনের সেবক না ভাবার পেছনে যত না তাদের হীন মানুষিকতা দায়ী তার চেয়ে বরং বেশি দায়ী আমাদের রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ণ । আমাদের রাজনীতিবিদরা গায়ের জোড়ে তাদের ক্ষমতার মসনদ টিকিয়ে রাখার জন্য নিজেরাই যখন এই প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের নিজেদের হীন কায়েমী স্বার্থে ব্যবহার করে ভাঙ্গা চেয়ারকে দাঁড় করিয়ে রাখে। তখনি এর সুযোগ গ্রহন করে এই আমলা কর্মচারীরা। আর ক্ষমতায় থাকা ভঙ্গুর রাজনীতিবিদদের অধিকাংশ সময়ই কোন নৈতিক সাহস থাকে না রাষ্ট্রের কর্মচারীদের নিয়ন্ত্রন করতে। কারণ, তারা জানে তাদের চেয়ার জনগনের শক্তিতে নয় বরং ঐ প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের শক্তিতেই বলিয়ান হয়ে আছে।

আমাদের সংবিধানের মূল ঘোষনায় বলা আছে, এই রাষ্ট্রের মালিক জনগন। অর্থাৎ আমাদের দেশের রাষ্ট্রীয় নামই হচ্ছে গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। কিন্তু আমাদের আমলারা কোন মতে একটি চেয়ারে বসতে পারলেই নিজেদের অন্য গ্রহের বাসিন্দা ভাবতে শুরু করে। কেন একজন জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারকে রাষ্ট্রের স্টেক হোল্ডারকে স্যার বলতেই হবে। বিসিএসের মাধ্যমে সরকারি চাকুরিতে প্রবেশ করা দেশের এই শিক্ষিত মেধাবী সন্তানগুলো কেন চেয়ারে বসেই নিজেদের স্যার স্যার ডাক শুনার জন্য অস্থির হয়ে যায়। দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ থেকে বের হয়ে আসা এই মেধাবী মুখ গুলো মুহুর্তেই কেন অনৈতিকতায় জড়িয়ে পড়ে। তাহলে কি বলব, তারা পুঁথিগত বিদ্যায় শিক্ষিত হলেও প্রকৃত মানুষ হয়ে উঠতে পারেনি। নিজেদের মধ্যে ধারণ করতে পারেনি নৈতিক শিক্ষা। আর তা না হলে একটি পাবলিক বিশ^বিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপককে কেন স্যার বলতে বাধ্য করার অপচেষ্টা করবে একজন ডেপুটি কমিশনার।

একজন ডিসি বা ডেপুটি কমিশনার হচ্ছেন সরকারের জেলা পর্যায়ের সর্বোচ্চ প্রতিনিধি। তৃণমূল পর্যায়ের এই নীতি নির্ধারকের রিপোর্টের ভিত্তি করেই সরকার ঐ জেলায় তার কর্মপরিকল্পনা বা নীতি প্রনয়ন করেন। কারণ, সরকার তো আর কোন ব্যক্তি নয়। এটি একটি সংঘবদ্ধ প্রতিষ্ঠান। অনেক গুলো স্তরের উপরই একটি সরকার দাঁড়িয়ে থাকে। জেলা প্রশাসক সরকারের সেই একটি স্তর মাত্র। এই স্তরগুলোতে যখন গলদ থাকে তখন গোটা রাষ্ট্র ব্যবস্থায়ই লেজে গোবরে অবস্থা সৃষ্টি হয়। আর এই অচলাবস্থা বা লেজে গোবরে অবস্থার জন্য দায়ী আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব।

একজন প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীকে স্যার বলার বিষয়ে আমাদের সংবিধানে কোন উল্লেখ নেই। সংবিধানে বলা আছে, প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা জনগনের সেবক। এখন এই সেবা গ্রহনকারী আর সেবা প্রদানকারীর পারস্পরিক শ্রদ্ধার ভিতর দিয়েই আসলে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে, কাজ করতে হবে। সেবা নিতে আসা নাগরিক যদি স্বত্ব:স্ফুর্ত ভাবে জেলা প্রশাসক বা পুলিশ সুপার বা যে কোন পর্যায়ের কর্মকর্তাকে স্যার বলে সম্বোধন করে তাতে কিন্তু আমাদের সংবিধান লংঘন হয় না আবার সেবাগ্রহনকারী নাগরিক যদি স্যার বলে সম্বোধন নাও করে তাতেও কিন্তু সংবিধানের কোন অবমাননা করা হয় না।

স্যার বলা না বলার ক্ষেত্রে সরকারি চাকুরির বিধিতেও কিন্তু কথা নেই। তাহলে ইউএনও, ওসি, ডিসি, এসপি হয়েই কেন স্যার ডাক শুনার জন্য এত উতালা হয়ে যায় হাল আমলের আমলারা। এসপি, ডিসিদের এতই যদি স্যার ডাক শুনতে মজা লাগে তাহলে কেন তারা শিক্ষকতা পেশায় গেল না। শিক্ষকতা পেশায় থাকলেতো জয়েন করা থেকে শুরু করে কবরে যাওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি স্যার ডাক শুনতে পারবেন। এমনকি কবরে গেলেও কিন্তু বলবে অমুক স্যার কিন্তু মারা গেছে ইত্যাদি।

খুব বেশি দিনের আগের কথা না। মাত্র বছর এক বা দেড় হবে। বুড়িচং উপজেলার এক নির্বাহী কর্মকর্তাকে এক বয়স্ক ব্যক্তি মা বলে সম্বোধন করায় তেলে বেগুনে জ্¦লে উঠেন তিনি। এমনকি ধমক দিয়ে অফিস থেকে বের করে দেন। তখনও আমরা গণমাধ্যমের কর্মীরা এই বিষয়ে সোচ্চার ছিলাম। জাতীয় ও স্থানীয় গণমাধ্যমে সংবাদ শিরোনাম হয়েছিল বুড়িচংয়ের ইউএনও।

আসলে সত্যি কথা বলতে কি আমাদের গোটা সমাজটাই কেন জানি দিন দিন অসহিঞ্চু হয়ে উঠছে। কেউ কাউকে সহ্য করতে পারছে না। দিন শেষে সবাই চায় নিজের সম্মানটা। কিন্তু নিজে কতটুকু কাজ করেছে সেই হিসেবটুকু নেয়ার সময় যেন কারো নেই।

রংপুর ডিসির স্যার কান্ডের পর অবশেষে মুখ খুলেছেন জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন। তিনি বলেছেন, সরকারি কর্মচারীরা জনগনের সেবক।তাঁদের স্যার বা ম্যাডাম ডাকার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। ভদ্রতার খাতিরে অনেকে স্যার বা ম্যাডাম ডাকেন। কিন্তু এটি ডাকা বাধ্যতামূলক কিছু নয়। কেউ যদি আপা বা ভাই ডাকেন, তাতে দোষের কিছু নেই। এতে মাইন্ড করারও কিছুই নেই।

লেখাটি শেষ করতে চাই, মাননীয় জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রীর কথাটির সারমর্ম দিয়েই। আমাদের আমলারা যেন এখন থেকে মনে না করেন দেশের জনগণ তাদের স্যার ডাকতে বাধ্য। কেউ যদি স্বেচ্ছায় প্রণোদিত হয়ে স্যার ডাকেন, ডাকবেন। আবার কেউ যদি ভাই বা ম্যাডাম বলে সম্বোধন করেন, করবেন। কিন্তু আমাদের আমলা মহোদয়গণ যেন এখন থেকে আর মাইন্ড না করেন। তারা যেন সব সময় এটাই মনে করেন যে, প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসেবে তাদের একমাত্র কাজ হচ্ছে জনগনের সেবক হয়ে কাজ করা, প্রভু হয়ে থাকা না। এই সহজ সত্য বুঝটি আমাদের আমলাগণ যত তারাতারি বুঝবেন তত দ্রুতই আমাদের দেশ এবং দেশের মানুষের জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে।

লেখক : সাংবাদিক, সংগঠক ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক লেখক।