ডেঙ্গু টিকার কার্যকারিতা: বৈশ্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে বাংলাদেশ

স্টাফ রিপোর্টার
প্রকাশ: ১০ মাস আগে

বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বে জনস্বাস্থ্যের জন্য বড় উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে ডেঙ্গু। সম্প্রতি এ রোগে মৃতের সংখ্যাও বাড়ছে। এমন পরিস্থিতিতে ডেঙ্গু প্রতিরোধী টিকা নিয়ে বিশ্বব্যাপী আলোচনা শুরু হয়েছে। এরই মধ্যে অন্তত ২০টি দেশে বিভিন্ন বয়সের মানুষের শরীরে প্রয়োগ শুরু হয়েছে এ টিকা। এসব দেশে টিকার কার্যকারিতা ও প্রতিক্রিয়ার পাশাপাশি বৈশ্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে বাংলাদেশ।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডেঙ্গুর টিকা বিষয়ে এখনই কোনো সিদ্ধান্তে আসা কঠিন। এর কার্যকারিতা ও প্রতিক্রিয়ার বিষয়ে নিশ্চিত হতে এবং অন্যান্য টিকার মতো গণপরিসরে প্রয়োগের জন্য দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হবে।

ডেঙ্গুর নির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা নেই উল্লেখ করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) বলছে, এ রোগ এড়াতে মশার কামড় প্রতিরোধই সবচেয়ে ভালো পদ্ধতি। ডেঙ্গভ্যাক্সিয়া নামে একটি টিকা রয়েছে। যাদের অন্তত একবার ডেঙ্গু হয়েছে ও ডেঙ্গুপ্রবণ এলাকায় বাস করছে তাদের এ টিকা দেয়া হচ্ছে। জাপানের টেট্রাভ্যালেন্ট টিকার কথাও উল্লেখ করেছে সংস্থাটি।

যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন (এফডিএ), ডব্লিউএইচও ও বিজ্ঞান সাময়িকী নেচারের সূত্রে জানা যায়, বর্তমান ২০টি দেশে ডেঙ্গুর দুটি টিকা প্রয়োগ করা হচ্ছে। তার একটি হচ্ছে ফ্রান্সের বহুজাতিক ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান সানোফির তৈরি ডেঙ্গভ্যাক্সিয়া, জাপানের তাকেদা ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের বানানো কিউডেঙ্গা। এসব টিকা এখন বাজারজাত করা হচ্ছে। তবে সব বয়সীদের এ টিকা দেওয়া হচ্ছে না। টেট্রাভ্যালেন্ট টিকা রয়েছে শেষ পর্যায়ের ট্রায়ালে।

দেশের জনস্বাস্থ্য, অণুজীববিজ্ঞান, ভাইরাস ও টিকা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিভিন্ন দেশে এসব টিকা প্রয়োগের পর কেমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে তা বিবেচনা করছে ডব্লিউএইচও। বাংলাদেশও সংস্থাটির পরামর্শের অপেক্ষায় রয়েছে। টিকাটি কতদিন সুরক্ষা দিতে সক্ষম তা নিশ্চিত নয়। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়েও সুনির্দিষ্ট কোনো ফলাফল মেলেনি। দেশের কোনো আনুষ্ঠানিক ফোরামে টিকার বিষয়ে আলোচনা হয়নি।

ডেঙ্গু ভাইরাসের চারটি ধরন রয়েছে। প্রথমবার কোনো একটি ধরনে আক্রান্ত হলে পরিস্থিতি মারাত্মক হয় না। দ্বিতীয়বারও একই ধরনে আক্রান্ত হলে সমস্যা প্রকট হয় না, তবে দ্বিতীয়বারে ভিন্ন কোনো ধরনে আক্রান্ত হলে রোগীর অবস্থা মারাত্মক হওয়ার আশঙ্কা থাকে। অন্যান্য ভাইরাসের ক্ষেত্রে টিকা প্রয়োগ করা হলে তা ঐ ভাইরাসের যেকোনো ধরন, উপধরনকে প্রতিরোধ করতে সক্ষম। কিন্তু ডেঙ্গুর যে ধরনে আক্রান্ত হওয়ার পর আক্রান্তকে টিকা দেয়া হয়েছে পরবর্তী সময়ে তা শুধু সেই ধরন প্রতিরোধের ক্ষেত্রে কার্যকর দেখা গেছে। অন্যান্য ধরনে আক্রান্ত হলে রোগীর অবস্থা মারাত্মক হতেও দেখা গেছে। সানোফির টিকা প্রয়োগের পর দেখা যায়, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে টিকা না নেয়াদের তুলনায় টিকা নেয়া শিশুদের অবস্থা সংকটাপন্ন হয়েছে বেশি। সানোফির টিকার ক্ষেত্রে যেসব শিশুর আগে ডেঙ্গু হয়েছিল শুধু তাদেরই টিকা প্রয়োগের সুপারিশ করা হয়েছে। টেট্রাভ্যালেন্ট নামে তাকেদার আরো একটি টিকার পরীক্ষামূলক প্রয়োগ চলছে ব্রাজিলে। তবে তারও কোনো কার্যকরী ফলাফল পাওয়া যায়নি।

গত ৩০ জুন ইউএস এফডিএ ডেঙ্গভ্যাক্সিয়া টিকার অনুমোদন দিয়েছে। ৬ থেকে ১৬ বছর বয়সীদের এ টিকা দেয়া যাবে। দেশটির রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র (সিডিসি) বলছে, ৯ থেকে ১৬ বছর বয়সীদের প্রদানের অনুমোদন হয়েছে। তবে তাদের আগে ডেঙ্গু সংক্রমণের ইতিহাস থাকতে হবে এবং বসবাস থাকতে হবে ডেঙ্গুপ্রবণ এলাকায়।

এদিকে জাপানের তাকেদা ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের ‘কিউডেঙ্গা’ টিকা ব্রাজিলে অনুমোদন পেয়েছে। গত ১৪ মার্চ দেশের ২৮ হাজার শিশু ও প্রাপ্তবয়স্কদের ওপর এ টিকা প্রদানের অনুমোদন দিয়েছে দেশটির ওষুধ নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ। যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয় বলছে, ৪ থেকে ৬০ বছর বয়সীদের এ টিকা দেয়া যাবে। টিকা প্রয়োগের ক্ষেত্রে আগে ডেঙ্গুর সংক্রমণ ছিল কিনা তা পরীক্ষার প্রয়োজন পড়ে না। এ টিকা ডেঙ্গুর ডেন-২ ধরনের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে। তবে অন্য তিনটি ডেন থেকেও সুরক্ষা দেবে কিউডেঙ্গা। তিন মাসের ব্যবধানে দেয়া টিকার দুটি ডোজ চার বছরের জন্য সুরক্ষা দিতে সক্ষম। টিকাটি ৮৪ শতাংশ ক্ষেত্রে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ঠেকাতে আর ৬১ শতাংশ ক্ষেত্রে ডেঙ্গুর মারাত্মক উপসর্গ প্রতিরোধ করতে সক্ষম।

এদিকে গত জুনে কিউডেঙ্গার অনুমোদন চেয়ে তাকেদা এফডিএতে যে আবেদন করেছিল তা প্রত্যাহার করে নিয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি বলেছে, এফডিএর সঙ্গে আলোচনা করে আবেদন প্রত্যাহার করা হয়েছে। মূলত আবেদনের সময় আরো কিছু তথ্য যুক্ত করা অত্যাবশ্যকীয় ছিল। তবে ইউরোপীয় কমিশন এ টিকাকে অনুমোদন দিয়েছে বলে জানিয়েছে ইউরোপিয়ান মেডিসিন এজেন্সি (ইএমএ)। সংস্থাটি বলছে, কিউডেঙ্গা টিকা প্রাপ্তবয়স্ক, কিশোর ও চার বছরের বেশি বয়সী শিশুদের দেয়া যেতে পারে। এ টিকা ডেঙ্গুর চারটি সেরোটাইপের বিরুদ্ধেই কাজ করতে সক্ষম।

ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের পরিচালক (ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল ও প্রশাসন) মো. সালাহউদ্দিন বলেন, সানোফি ও তাকেদা যে টিকা বাজারজাত করেছিল তা প্রত্যাহার করে নিয়েছে। এ টিকাগুলোর কার্যকারিতা তেমন ভালো না। এগুলো ৬০ শতাংশ ক্ষেত্রে রোগ প্রতিরোধ করতে সক্ষম। যদিও ৫০ শতাংশ কার্যকরী হলেই অনুমোদন পায়। তবে টিকাগুলোর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ইতিহাস ভালো নয়। বাংলাদেশেও ডেঙ্গুর কোনো টিকা নিবন্ধিত নেই। তবে আইসিডিডিআর,বি একটা টিকার দ্বিতীয় পর্যায়ের ট্রায়াল চালাচ্ছে।

বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞান সাময়িকী নেচারের এনপিজি ভ্যাকসিনস বলছে, বিশ্বব্যাপী ডেঙ্গুর বোঝা কমানোর জন্য বহুমুখী পদ্ধতির ভিত্তি হিসেবে টিকার স্বীকৃতি রয়েছে। তবে এর নিরাপদ প্রয়োগ ও কার্যকারিতা অর্জন বেশ কঠিন। ডেঙ্গুর চারটি ধরনই সংক্রমণ, রোগ ও মৃত্যু ঘটাতে সক্ষম। কিন্তু পশুর ওপর টিকা প্রয়োগের ফলে যে ইমিউনের সৃষ্টি হয়েছে তা মানুষের ডেঙ্গু সংক্রমণ ও রোগের অভিজ্ঞতাকে বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করতে অক্ষম। ফলে ডেঙ্গুর চারটি ধরনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সক্ষমতা সুনির্দিষ্টভাবে বোঝা কঠিন।

সরকারের টিকাসংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি উপদেষ্টা কমিটির (নাইট্যাগ) কো-চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মাহমুদুর রহমান বলেন, ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর কোনো টিকার অনুমোদন দেওয়ার পর তা নাইট্যাগে আসবে। টিকার বিভিন্ন বিষয় পর্যালোচনা করে আমরা সুপারিশ জানাব। আমাদের কমিটিতে এ বিষয়ে এখনো কোনো আলোচনা হয়নি। কোনো টিকা আমাদের সুপারিশের জন্য এলে সেটা দেশে কতটুকু কার্যকর করা যাবে, এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কী হতে পারে সেসব বিবেচনা করা হয়। ২০১৮ সালে এ টিকা ফিলিপাইনে প্রয়োগ করা হলে তখন অনেকের মৃত্যু হয়েছিল। পরীক্ষা করে নিশ্চিত হয়ে তবেই টিকা দেওয়া হবে।

তিনি বলেন, ডেঙ্গুর চারটি ধরনকেই প্রতিরোধ করতে সক্ষম হলে বলা যাবে টিকাটি কার্যকর হবে। পরীক্ষামূলকের পর গণপরিসরে প্রয়োগ করতে গিয়ে যদি জটিল পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেয় তখন কী হবে, এটা বড় প্রশ্ন। গণপরিসরে টিকা পরীক্ষা করে দেয়া সম্ভব হবে না। সুতরাং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় মৃত্যু বা হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে না এমনটা নিশ্চিত থাকতে হবে। ডব্লিউএইচও টিকার বিষয়ে কী সুপারিশ করছে তা গুরুত্বপূর্ণ। এফডিএ যদি কোনো টিকার বিষয়ে অনুমোদন দেয় তাহলে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর এ টিকা নিয়ে ভাবতে পারে। এফডিএ ছোট পরিসরে নির্দিষ্ট বয়সসীমার জন্য টিকার অনুমোদন দিয়েছে। আবার বলেছে, পরীক্ষা করে নিতে হবে। এত শর্ত দিয়ে একটি টিকা দিতে হলে তো গণপরিসরে টিকাটি দেয়া যাবে না। অন্যদিকে বাংলাদেশে মানুষের সঠিক বয়স নিয়েও বিতর্ক রয়েছে।

বর্তমানে বিশ্বের অন্তত ২০টি দেশে ডেঙ্গুর টিকার অনুমোদন রয়েছে উল্লেখ করে এনপিজি ভ্যাকসিনস জানিয়েছে, ২০১৫ সালে প্রথম মেক্সিকোয় সানোফির ডেঙ্গভ্যাক্সিয়া অনুমোদন পায়। যদিও তখন টিকার কার্যকারিতা তেমন পাওয়া যায়নি।

ডব্লিউএইচও, এফডিএ, নেচার, প্রেসিশান ভ্যাকসিনেশন ও ওষুধের বাজার নিয়ে বৈশ্বিক গবেষণাকারী প্রতিষ্ঠান এফএমআই সূত্রে জানা গেছে, এ পর্যন্ত ডেঙ্গভ্যাক্সিয়া ও কিউডেঙ্গা অন্তত ২০টি দেশে অনুমোদন পেয়েছে। দেশগুলোর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল, মেক্সিকো, ইন্দোনেশিয়া, সিঙ্গাপুর, আর্জেন্টিনা, পর্তুগাল, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড, পেরু, এল সালভাদর উল্লেখযোগ্য।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (গবেষণা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবির বলেন, টিকার বিষয়ে বৈজ্ঞানিকভাবে এগিয়ে যেতে হবে। টিকার ইতিবাচক ও নেতিবাচক অনেকগুলো দিক রয়েছে। টিকা দিলে সবাইকেই দিতে হবে। যাকে প্রয়োগ করা হবে তিনি আগে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন কিনা তা নিশ্চিত হতে হবে। ইউরোগের যে দেশগুলোয় টিকা নিয়ে কথা হচ্ছে সেখানে ডেঙ্গু কম। বাংলাদেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্তের হার বেশি, সেক্ষেত্রে টিকা প্রয়োগ কঠিন। এ টিকা খুব ব্যয়বহুল। ডব্লিউএইচও গাইডলাইন দিলে বিষয়টি নিয়ে পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে। এ মুহূর্তে ডব্লিউএইচওর বাইরে গিয়ে আমরা কিছু করতে পারব না। ডব্লিউএইচওর আঞ্চলিক সভায় আমরা বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করব। গ্যাভি ভ্যাকসিন অ্যালায়েন্স এবং অন্যদের সঙ্গেও আমরা কথা বলব।